মৌলভীবাজার প্রতিনিধিঃ
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী ভৈরবগঞ্জ বাজার এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকা এ প্রাচীন গ্রামীণ হাট আজও প্রাণবন্ত ও জমজমাট। প্রতি শুক্রবার এখানে হাঁস-মোরগ, কবুতর, ছাগল, ভেড়া, মেষসহ নানা ধরনের পোষা প্রাণীর কেনাবেচা হয়। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতার উপচে পড়া ভিড়ে সরগরম থাকে পুরো বাজার।
গত শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাটের পশ্চিম দিকে হাঁস-মোরগ ও নানা পোষা প্রাণীর সারি। কেউ এনেছেন দেশি মোরগ, কেউ কবুতর বা তিতির পাখির ছানা, কেউ আবার খরগোশ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নিজ নিজ পোষা প্রাণী বিক্রির জন্য হাজির হয়েছেন। হাটের পূর্ব দিকে বসেছে ছাগল ও পাঁঠার সারি। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিক্রেতারা প্রাণী নিয়ে আসেন এখানে। দুপুরের পর থেকেই শুরু হয় জমজমাট কেনাবেচা, যা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যা নামতেই হাটের কোলাহল মিলিয়ে যায়। ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা প্রাণী নিয়ে ঘরে ফিরলে মুহূর্তেই পরিণত হয় “ভাঙা হাটে।”
শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের মৌলভীবাজার–শ্রীমঙ্গল মহাসড়কের পাশে অবস্থিত ভৈরবগঞ্জ বাজার একসময় রাস্তার ধারেই বসত। বর্তমানে বাজারের উত্তর পাশে ব্যক্তিগত জমি ইজারা নিয়ে হাটটি সম্প্রসারিত করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে এটি “ভৈরবগঞ্জ বাজার” নামেই পরিচিত।
শুধু শ্রীমঙ্গল বা মৌলভীবাজার নয়, পুরো সিলেট অঞ্চলে পরিচিত এ বাজারটি। বিক্রির পরিমাণ ও অংশগ্রহণের দিক থেকে এটি সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় পোষা প্রাণীর হাট হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। স্থানীয়দের মতে, বাজারটির বয়স অন্তত একশ বছর। চা-বাগানঘেরা এলাকা, হাইল হাওর ও আশপাশের গ্রামগুলোকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে এটি টিকে আছে।
অন্যদিনের মতো এখানে প্রতিদিনই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, সবজি, মাছ ও মৌসুমি ফল বিক্রি হয়। তবে গত দুই দশক ধরে শুক্রবারের বিশেষ হাটটি আলাদা পরিচিতি পেয়েছে। তখনই জমে ওঠে হাঁস-মোরগ, ছাগল, কবুতর ও অন্যান্য পোষা প্রাণীর বিশাল আয়োজন।
ভৈরবগঞ্জ বাজারের ইজারাদার লিটন আহমেদ বলেন, “হাটটির বয়স শত বছরের বেশি। তবে গত ২০ বছর ধরে এটি হাঁস, মোরগ, ছাগলসহ বিভিন্ন প্রাণীর হাট হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে বিক্রেতারা প্রাণী নিয়ে আসেন। শুক্রবার বেলা আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত চলে হাট।”
রাজনগর থেকে আসা এক বিক্রেতা জানান, তিনি দুটি পোষা মেষ নিয়ে এসেছিলেন। দাম উঠেছে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত, তবে তিনি ১২ হাজার টাকার নিচে বিক্রি করতে রাজি নন। তাই মেষ দুটি ফেরত নিয়ে যেতে হয়েছে।
বাজারের ব্যবসায়ী হাম্মাদ তাহমীম বলেন, “ভৈরবগঞ্জ বাজার শুধু মৌলভীবাজার নয়, পুরো সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো গ্রামীণ হাট। শুক্রবার এখানে মানুষের ঢল নামে। এই হাটের কারণে আশপাশের দোকান ও হোটেল ব্যবসাও জমে ওঠে।”
স্থানীয় বাসিন্দা ফাহিম আল হাসান জানান, “আমি ছোটবেলা থেকেই এই হাট দেখছি। তখন এখানে শুধু গরু-ছাগল বিক্রি হতো। এখন নানা ধরনের পোষা পাখি আর প্রাণী বিক্রি হয়। শুক্রবার এলে মনে হয়, যেন উৎসবের আমেজ নেমে আসে বাজারে।”
আরেক স্থানীয় যুবক মনিরুল ইসলাম বলেন, “ভৈরবগঞ্জ বাজার এখন শুধু বেচাকেনার জায়গা নয়, এটা আমাদের এলাকার ঐতিহ্য। আশপাশের গ্রাম থেকে সবাই এই দিনটার অপেক্ষায় থাকে।”
স্থানীয়দের ভাষায়—“ভৈরবগঞ্জ বাজার আজ শুধু একটি হাট নয়, এটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্য ও অর্থনীতির প্রাণ।”
এম এস/ এস সি/ এইস এম