মোস্টবেট বাংলাদেশের সেরা বুকমেকার। স্পোর্টস বেটিং, অনলাইন ক্যাসিনো সকলের জন্য সীমাবদ্ধতা ছাড়াই উপলব্ধ, এবং একটি ব্যাঙ্ক কার্ডে Mostbet withdrawal সম্ভব!
Türkiye'nin en iyi bahis şirketi Mostbet'tir: https://mostbet.info.tr/

বাংলাদেশ, বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা


প্রকাশের সময় :১৫ জুলাই, ২০২১ ৫:৪১ : অপরাহ্ণ

ড. মিল্টন বিশ্বাস

কবি আসাদ মান্নান ১৩ জুলাই (২০২১) তাঁর ফেসবুকে ‘‘মানবতা কখনও হারে না’’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি পড়ে চমকে উঠেছি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যকে তিনি তুলে ধরেছেন। ‘ইতিহাসের বরকন্যা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতা বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা হিসেবে মানবতার দিশারি হয়ে উঠেছেন। বিশ্বব্যাপী তাঁর মহিমা আজ কীর্তিত হচ্ছে। কবি লিখেছেন-

‘‘আজ রাতে ঘুমোতে যাবার আগে
একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে
একটা খবর দেখে মনে হলো
করোনা পীড়িত এই দুঃসময়ে
আমাদের আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বুক থেকে
এক লক্ষ টন ভারি
একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বোঝা
হঠাৎ আশার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে,
আশা জাগলো মনে,আশা–
একদিন বুকটা হালকা হয়ে যাবে।
শুধু মাত্র নাবাচক চরিত্র দোষের জন্য
আমি পারতপক্ষে এ কাগজের পাতায় চোখ রাখতে
নিজেকে বিরত রাখি;
নিজ পকেটের টাকা খরচে কে সে নির্বোধজন
স্বপ্ন ও আশার পরিবর্তে
হতাশা ও অন্ধকার ক্রয় করে!
কাগজটার অনলাইন সংস্করণ বলে কথা —
অন্ধকারে হঠাৎ আলোর বার্তাঃ
জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে
মায়ানমারের সামরিকজান্তা বিরোধী
রোহিঙ্গা বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত ।
খবরটা আনন্দের বটে;
এ সংবাদ পড়ে যারা মনে শান্তি পেয়েছেন কিংবা
অক্সিজেন সংকটে বুকটা ফুলিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন
দয়া করে হাত তুলুন,
জায়গা থেকে আওয়াজ দিন
বিনা মূল্যে কাঙ্ক্ষিত শান্তি পৌঁছে যাবে
ইনশাল্লাহ… … …
শুধু জায়গা থেকে আওয়াজ দেবেন,
আওয়াজ, আওয়াজ…
একবার সেই প্রিয় চির অম্লান
জয়ধ্বনি শুনতে চাইঃ জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু…
হ্যাঁ, সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে
ইতিহাসের বরকন্যা কখনই ভুল করেননি–
তাঁর ভুল হয়না,
তিনি পিতার মতো ভবিষ্যতদ্রষ্টা
তিনি সব কিছু দেখতে পান
তিনি ঠিকই জানেন,
মানবতা কখনও হারে না।’’ কবির চোখে ‘পিতার মতো ভবিষ্যতদ্রষ্টা’ শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যে আজ বিরুদ্ধ পক্ষও আনন্দিত। সকলের মুখে ‘ইতিহাসের বরকন্যা’র জয়ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। কারণ ১২ জুলাই(২০২১) মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিত এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দ্রুত রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার পর এই প্রথম জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে কোনো প্রস্তাব ভোটাভুটি ছাড়া পাস হয়েছে। এ বিবেচনায় এবারের প্রস্তাবটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় মাইলফলক। জেনেভায় জাতিসংঘ বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অর্জিত এই সাফল্য প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের নিরবচ্ছিন্ন তদারকির ফল।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের চলতি অধিবেশনে বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সব সদস্যরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘রোহিঙ্গা, মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি পেশ করা হয়। মিয়ানমারের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শুরু থেকেই প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয়ে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর মধ্যে প্রবল মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। অবশেষে নিবিড় ও সুদীর্ঘ আপস-আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। ওআইসির ওই প্রস্তাবটিতে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। এ ছাড়া তাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া পর্যন্ত এ গুরুভার বহনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়। বিশ্ববাসী জানেন যে, ২০১৭ সালে মানবিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমানা উন্মুক্ত করে দেন। এজন্য বাংলাদেশকে নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এদিক থেকে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে উক্ত প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ায় মানবতার জয় ঘোষিত হয়েছে।

২.

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার ছবি, ভিডিও, নারী-শিশু-বৃদ্ধদের কান্না, চিৎকার, আহাজারি প্রভৃতি বিশ্বসহ এদেশের সকলে দেখেছেন, জেনেছেন। সেই দেখায় পালিয়ে আসা মানুষের চোখের চাহনির যে আকুলতা বা ব্যাকুলতা তা গাম্বিয়াসহ বিশ্বের সকলকে কাতর করেছিল। তবে তার আগে গত কয়েক দশকে তাদের সংখ্যা এদেশে পাঁচ লাখের কাছে পৌঁছেছিল। সেই সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ১১ লাখের বেশি। আর শেখ হাসিনা সরকার সীমিত সাধ্য নিয়ে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের বাঁচানোর এবং নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর। মানুষ হিসেবে আমরা অবশ্যই এই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলছি। স্মরণীয়, ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে শুরু হয় সেনা অভিযান; এরপর বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল। জাতিসংঘের মতে বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা। বাংলাদেশে অবস্থানরত শরণার্থী বাদেও বর্তমানে প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করে। সামরিক সরকার (১৯৬২ থেকে) তাদের অনেক মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ২০১২ সালে ট্রেনে রোহিঙ্গা মুসলমান কর্তৃক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুণী ধর্ষণের জের ধরে সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের দ্বারা পরিচালিত বর্বরতায় প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম দেশত্যাগ করে। সে দেশ ছাড়াও বিভিন্ন সময় সামরিক জান্তার নির্যাতনের কারণে অতীতে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে মালেশিয়ায় প্রায় ৫০ হাজার, বাংলাদেশে ৫ লক্ষ এবং প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা সৌদি-আরবে পালায়। ২০১৭ থেকে সেখানে সামরিক অভিযান চলানো হয় ‘মুসলমান রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা’ হিসেবে। ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামের কমপক্ষে ৮৩০টি বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। একথা সত্য এসব অত্যাচার-নিপীড়নের ফলে সেখানে জন্ম নিয়েছে রোহিঙ্গা বিপ্লবীগোষ্ঠী। কিন্তু সেই বিপ্লবীগোষ্ঠীকে আমরা সমর্থন করি না। কারণ মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী আমরা। তবে অসহায় ও নির্যাতিত এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের পাশে থাকা আমাদের মানবিক দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। রোহিঙ্গাদের মানবিক দায়বদ্ধতায় আশ্রয় প্রদান থেকে শুরু করে সব ধরনের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করায় শেখ হাসিনাকে বিশ্বসভায় অভিষিক্ত করা হয় ‘মানবতার জননী’ হিসেবে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সংকট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট। ৬৩ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে তিরিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সেনাবাহিনীর ওই হামলায় কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমায় বাংলাদেশে। অনেকেই মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ওই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।

৩.

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ২০১৭ সালে বিশ্ব গণমাধ্যমগুলো শিরোনাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার মূল কথা হলো- শেখ হাসিনা এক মানবিক রাষ্ট্রনায়কের প্রতিচ্ছবি। (চ্যানেল অন অনলাইন, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭) মূলত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যমে প্রশংসিত এবং মানবিক এক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনা বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হন। সেসময় তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে আরো সাত লাখকেও খাওয়াতে পারবো।’’

২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে গিয়ে শেখ হাসিনা তাদের সাহস এবং আশা ধরে রাখার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো একদিন নিশ্চয়ই তাদের নিজদেশে ফিরতে পারবে। ২০১৭ সালেই প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য নতুন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ দেন। এরপর ভাসানচরে স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলা হয় রোহিঙ্গাদের জন্য।

ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন, এই সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতি তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। হিন্দুস্থান টাইমসও একই ধরনের শিরোনাম করে লিখেছে, শেখ হাসিনা মিয়ানমারের কাছে নিজদেশের নাগরিকদের ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। যতক্ষণ সেটা না হচ্ছে ততক্ষণ রোহিঙ্গাদের সাময়িক সহায়তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন তিনি।

নিউজ১৮ প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের ওপর ফোকাস করে শিরোনাম করেছে। লিখেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার বর্বরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গারা যেন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায় সেজন্য সেখানে সেফ জোন বা নিরাপদ এলাকা তৈরি করার পরামর্শও দিয়েছেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ফার্স্টপোস্ট বলেছে, শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের বলেছেন, তার দেশ এমন অবিচার সহ্য করবে না। পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন লিখেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্বর আচরণের কারণে ভর্ৎসনা করেছেন এবং তাদের ফিরিয়ে নিতে জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তান টুডেও একই ধরনের সংবাদ প্রকাশ করেছে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি উখিয়ায় অবস্থানকালে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের এক মিনিট ১৫ সেকেন্ড একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মিয়ানমারের উচিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গা গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালাতে দেওয়া মিয়ানমার সরকারের ঠিক হয়নি। সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, কেউ অমানবিক হলেও আমরা অমানবিক হতে পারি না। আমরা আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোকে আবার বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না, কারণ আমরা মানবিক। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের বিষয়টি দিয়ে শিরোনাম করে সংবাদ করেছে। লিখেছে, রাখাইনে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।

উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতার জননী বা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বলে আখ্যায়িত করেছে কয়েকটি ব্রিটিশ গণমাধ্যম। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট অন্যান্য বেশিরভাগ গণমাধ্যমের মতোই বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাদের সহায়তা করার আশ্বাসের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

৪.

২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ৭২ তম সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সহিংসতা, হত্যা, নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সমস্যা সমাধানে তিনি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তাবগুলো হলো- প্রথমত, অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা; দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা; তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় (safe zones) গড়ে তোলা; চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এছাড়া তিনি আরো বলেন, আমার হৃদয় আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। কেননা আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছে ক্ষুধার্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখচ্ছবি। আমি মাত্র কয়েক দিন আগেই আমার দেশে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। যারা ‘জাতিগত নিধনে’র শিকার হয়ে নিজ দেশ থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত। অথচ তারা হাজার বছরেরও অধিক সময় মিয়ানমারে বাস করে আসছেন। এদের দুঃখ-দুর্দশা আমি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর আমার ছোটবোনকে নিয়ে ছয় বছর উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার সময় মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলে গেছেন। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এমন এক বিশ্বব্যবস্থা গঠনে বাঙালি জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় সব মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে। এবং আমি জানি আমাদের এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে।’

শেখ হাসিনা আরো বলেন, এ মুহূর্তে নিজ ভূখণ্ড হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত আট লাখেরও অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। আপনারা সকলেই জানেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। এ নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে গত তিন সপ্তাহে চার লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া ঠেকানোর জন্য মিয়ানমার দেশটির অভ্যন্তরে সীমানা বরাবর স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। এতে আমরা ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এ সব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজদেশে ফিরে যেতে পারেন এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে।…

সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের নিন্দা জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধে এবং ওই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ও জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি চাই, মানব ধ্বংস নয় মানবকল্যাণ চাই। এটাই হোক আমাদের সকলের লক্ষ্যে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে এবং তার আগে ১৬ অক্টোবর মন্ত্রিসভার অভিনন্দন প্রস্তাবটি ছিল নিম্নরূপ-

‘‘সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত দৈনিক পত্রিকা খালিজ টাইমস-এ রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি মানবিক অবদান ও তা নিরসনে সুদূপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ÔStar of the EastÕ অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। খ্যাতিমান কলামিস্ট অ্যালান জ্যাকব গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ‘শেখ হাসিনা জানেন সহমর্মিতার নৈপুণ্য’-শীর্ষক লেখাটি উক্ত পত্রিকায় পোস্ট করেন। এই নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন যে, লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবন রক্ষায় সীমান্ত খুলে দিয়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত বিপন্ন মানুষের প্রতি শেখ হাসিনা যে সহমর্মিতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন, সে প্রেক্ষাপটে তাঁর চেয়ে বড় কোন মানবতার উজ্জ্বল নক্ষত্র বর্তমান বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দৃশ্যমান নয়। জ্যাকব বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো নেতারা যখন বিশ্ব-মানবতার কর্ণধার হন তখন আশার আলো জ্বলে ওঠে অভিবাসন সমস্যায় নিমজ্জিত তমসাচ্ছন্ন বিশ্বে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত, সীমিত সম্পদ ও ক্ষুদ্রায়তনের দেশটিতে একবারে ৪ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছেন শেখ হাসিনা- এটা তাঁর সহানুভূতিশীল হৃদয়, মানবিক সংবেদনশীলতা এবং অপরিসীম সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। অপরদিকে, গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রী আবেগঘন বিষাদময় পরিবেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আন্তরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা, একাত্মবোধ ও উদারতায় একান্ত সান্নিধ্যে মিলিত হন। নির্যাতিত নারী ও শিশুর মুখে নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও বর্বরোচিত অত্যাচারের বর্ণনা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাদেরকে সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাসসহ এই সংকটের স্থায়ী সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন যে মিয়ানমারে যা ঘটেছে তা মানবাধিকার লঙ্ঘন। তিনি বলেন, মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ তাদের নিরাপদ আশ্রয় ও খাদ্য যুগিয়ে যাবে এবং তাতে কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই পরিদর্শনের ওপর ধারণকৃত সংবাদ-ভিডিও লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘চ্যানেল ফোর’ কর্তৃক প্রচারিত হয়। চ্যানেল ফোর-এর এশিয়ান করেসপন্টেন্ট মি. জনাথান মিলার তাঁর প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মমত্ববোধ, মানবিকতা, মহানুভবতা ও উদারনৈতিক মানসিকতার জন্য তাঁকে ÔMother of HumanityÕ অভিধায় অভিহিত করেন। যুক্তরাজ্যে ভিডিও-প্রতিবেদনটি সর্বমহলে সমাদৃত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছে চ্যানেল ফোর-এর সংবাদভিত্তিক এই ভিডিও-প্রতিবেদনটি।’’

৫.

বাংলাদেশ নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিজ মার্সিয়া বার্নিকাট ২০১৮ সালের ২ মে গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী বরবার যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের লেখা একটি পত্র হস্তান্তর করেন। ওই পত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পাশাপাশি, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১৩ লক্ষাধিক মানুষকে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রদান করায় বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানা। একইসাথে তিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে এবং মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখবে বলে অঙ্গীকার করেন। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ২০১৮ সালের ৪-৬মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি সংস্থার সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫তম শীর্ষ সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা সফর করেন। তিনি ৪ মে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। ৫ মে তিনি শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। এ সময় রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রতি কানাডার অকুণ্ঠ সমর্থন পুনঃব্যক্ত করেন তিনি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। ইউএসএইডের প্রশাসক (প্রধান) মার্ক এ গ্রিনের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিনিধিদল ২০১৮ সালের ১৪-১৬ মে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসেন। তাঁরাও শেখ হাসিনার মানবতার গুণকীর্তন করেছেন।

অন্যদিকে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের গণহত্যার বিপদ থেকে সুরক্ষায় নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) সর্বসম্মতভাবে মিয়ানমারের প্রতি চার দফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে- ক) গণহত্যা সনদের বিধি ২ অনুযায়ী মিয়ানমারকে তার সীমানার মধ্যে রোহিঙ্গাদের হত্যা, জখম বা মানসিকভাবে আঘাত করা, পুরো জনগোষ্ঠী বা তার অংশবিশেষকে নিশ্চিহ্ন করা এবং তাদের জন্মদান বন্ধের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ থেকে অবশ্যই নিবৃত্ত থাকতে হবে। খ). মিয়ানমারকে অবশ্যই তার সীমানার মধ্যে সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো অনিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট বা তাদের সমর্থনে অন্য কেউ যাতে গণহত্যা সংঘটন, গণহত্যার ষড়যন্ত্র, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে গণহত্যার জন্য উসকানি দেওয়া, গণহত্যার চেষ্টা করা বা গণহত্যার সহযোগী হতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। গ) গণহত্যা সনদের বিধি ২-এর আলোকে গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সাক্ষ্যপ্রমাণ রক্ষা এবং তার ধ্বংস সাধনের চেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে। ঘ) এই আদেশ জারির দিন থেকে চার মাসের মধ্যে আদালতের আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আদালতকে জানাতে হবে। এরপর থেকে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পরপর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে। এগুলো মেনে চলা মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক। তারা আইসিজের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে না। তবে ওই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘ কয়েক দশকের জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং ২০১৭ সালের সেনা অভিযানের পটভূমিতে গাম্বিয়া আইসিজেতে সুরক্ষার আবেদন করে। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত দেশ গাম্বিয়া ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে নেদারল্যান্ডসে হেগের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে ওই মামলার প্রথম শুনানি শুরু হয়েছে, চলেছে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শুনানির জন্য ওই সময় আদালতে হাজির হয়েছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। বিচারে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ আন্তর্জাতিক সালিশীর কতখানি পরিপন্থী সেটা যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে ‘আইসিজে’ বিচারিক আদালতে বাদী-বিবাদী মুখোমুখি হয়। গাম্বিয়া বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী কোনো রাষ্ট্র নয়। কিন্তু প্রতিবেশী ভারত ও চীন যে মানবতার দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি তা ‘ওআইসি’র সমর্থনে একটি ক্ষুদ্র দেশ দেখিয়ে দিয়েছে। গাম্বিয়া বাদী হয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়ে যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা যেমন মনুষ্যত্বের অপার শক্তির প্রকাশ তেমনি অত্যাচার আর সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিবাদ হিসেবে তাৎপর্যবহ। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব রোহিঙ্গাদের মানবতা বিবর্জিত দুর্দশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও মিয়ানমার নির্বিকার ও নিরুদ্বেগ। কোনো মতে এমন অত্যাচার আর বর্বরোচিত জঘন্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র সুরাহার মনোবৃত্তি নেই। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ছিলেন নির্বিকার, ভাবলেশহীন। অবশ্য আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গাম্বিয়ার অভিযোগ উত্থাপনের আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই মিয়ানমারের অমার্জনীয় অপরাধের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিশ্বসভায় অভিযোগ করতে হয়েছে।

৬.

২০১৭ সাল থেকেই রোহিঙ্গাদের নির্যাতন-নিপীড়নের সমস্যা সারা বিশ্বব্যাপী সুশীল সমাজের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখন থেকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আট নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব রোহিঙ্গা গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে সু চিকে আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ শান্তিতে নোবেল বিজয়ীরা হলেন- শিরিন এবাদি(ইরান-২০০৩), লেমাহ গবোযি(লাইবেরিয়া-২০১১), তাওয়াক্কল কারমান (ইয়েমেন-২০১১), মাইরিড মাগুয়ের (উত্তর আয়ারল্যান্ড-১৯৭৬), রিগোবার্তো মেনচু তুম (গুয়াতেমালা-১৯৯২), জোডি উইলিয়ামস (যুক্তরাষ্ট্র-১৯৯৭) ও কৈলাশ সত্যার্থি (ভারত-২০০৬)। শান্তির পক্ষের মানুষ হিসেবে অং সান সু চি’র প্রতি তাঁরা আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তিনি যেন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলা বৈষম্য অবসানের ব্যবস্থা নেন এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, ভূমির মালিকানা, চলাচলের অধিকার এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কাজ করেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নিজে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ান এবং তাদের নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আহবান জানান এবং ৫ দফা দাবি পেশ করেন ২০১৭ সালের জাতিসংঘের অধিবেশনে। ২০১৮ সালেও তিনি শান্তির অন্বেষণে শরণার্থী সমস্যার সমাধানে নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। ২০১৯ সালে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। তারা এখন বিশ্বের জন্যও হুমকি। রোহিঙ্গাদের যদি দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া না হয় এ সমস্যা আরো বাড়তে থাকবে। বিভিন্ন দেশ এই সমস্যা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব সত্ত্বেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে না দিয়ে তাদের উপর মানসিক নির্যাতন করছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের নিরাপত্তা আজ ঝুঁকিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নীতি হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানো।

৭.

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী তামবাদু বলেছিলেন, ‘আমরা কেবল রোহিঙ্গাদের অধিকারের সুরক্ষাই চাই না বরং গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে মিয়ানমারকে গণহত্যা না চালাতে বাধ্য করে নিজেদের অধিকারও অক্ষুণ্ন রাখতে চাই।’ গণহত্যার কনভেনশনের অধীনে মিয়ানমার তার দায়বদ্ধতা লঙ্ঘন করেছে এবং করে যাচ্ছে; চলমান গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং দায়বদ্ধতার প্রতি পূর্ণ সম্মান জানাতে হবে- আদালতকে এমন ঘোষণা দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল গাম্বিয়া। গাম্বিয়া যুক্তি দেখিয়ে বলেছিল, মিয়ানমার ২০১৭ সালের অগাস্ট থেকে শুদ্ধি অভিযানের নামে ধারাবাহিকভাবে এবং ব্যাপকভাবে নৃশংসতা চালিয়ে গেছে, যেটি গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। গাম্বিয়ার আইনজীবীরা মিয়ানমারে ব্যাপক ধর্ষণ, হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া এবং রোহিঙ্গা শিশু হত্যার বিবরণ আদালতে তুলে ধরে। গাম্বিয়ার অভিযোগ এবং ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর তিন দিনের নির্ধারিত শুনানির পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপে পড়ে মিয়ানমার। বিশেষ করে দেশটির সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকার তখন থেকে রোহিঙ্গা বিষয়ে সঠিক পথে থাকতে বাধ্য হয়। কোনো বিতর্কিত কাজ করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পার পাওয়া আর সম্ভব হয়নি। আবার রোহিঙ্গা সংকট পরিস্থিতির উন্নতিতে মিয়ানমার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে হবে নিয়মিত বিরতিতে।

গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে মিয়ানমার। পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন হারিয়েছে তারা। আরোপ হয়েছে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নানা নিষেধাজ্ঞা। শুধু চীনা ঢালে ভবিষ্যতে আর রক্ষা পাবে না স্বৈরশাসকের দেশ। অর্থাৎ মিয়ানমার ‘আইসিজে’র চার দফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা মেনে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে- এটাই প্রত্যাশা আমাদের। এই প্রত্যাশায় আলো জ্বলেছে শেখ হাসিনার উদ্যোগে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের চলতি অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গাদের দ্রুত রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে।

লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো  নির্বাহী  সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগ :