স্টাফ রিপোর্টার:
চট্টগ্রাম নগরীর ব্যস্ততম সড়কগুলোর ফুটপাত দখল করে চলছে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি। আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাট, চকবাজার, কোতোয়ালী, ইপিজেডসহ বিস্তৃত এলাকায় শুধু ফুটপাত নিয়ে নয়; একই সাথে সড়ক দখল করেও চলছে চাঁদাবাজি। ফুটপাতে হকার বসিয়ে, সড়কে অবৈধ গাড়ি স্ট্যান্ড কিংবা ভ্যান গাড়ির ভাসমান বাজার বসিয়ে হাতিয়ে নেয়া টাকা। বিভিন্ন প্রভাবশালী গ্রুপ নামে-বেনামে এসব সড়ক-ফুটপাত দখলে যেন প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকর্মীর ইন্ধনে এসব ফুটপাত-রাস্তা দখলের অপতৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরবাসীরও দুর্ভোগ বাড়ছে। অবশ্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নগরীর ফুটপাত ও রাস্তার অবৈধ দখলদারিত্বের অবসানে সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে নগরজুড়ে প্রতিটি গুরুত্বর্পূণ রাস্তা ও ফুটপাত দখলের ঘটনা বাড়ছে। এসব রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে বসার জন্য হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। শুধু ফুটপাতই নয়; রাস্তার উপর বিভিন্ন ধরনের গাড়ির স্ট্যান্ড ও ভাসমান বাজার বসিয়েও আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এই টাকার ভাগ বাটোয়ারা হয় নানাভাবে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় থাকার ফলে সন্ত্রাসী চক্রগুলো দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
নগরীর নিউ মার্কেট, স্টেশন রোড, লালদীঘি থেকে কোতোয়ালী মোড়, জিপিও থেকে নিউ মার্কেট মোড়সহ যত্রতত্র গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ির স্ট্যান্ড। এসব গাড়ির অধিকাংশরই কোনো রুট পারমিট নেই। নেই ফিটনেসসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। কিন্তু সড়ক দখল করে স্ট্যান্ড বসিয়ে চলাচল করছে দিনের পর দিন। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সন্ত্রাসীদের নামধামসহ বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে বিভিন্ন সময় দফায় দফায় আবেদন করা হলেও তেমন কোনো সুফল মিলেনি। সন্ত্রাসীরা বরাবরই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অন্তত গত দশ বছর ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে চক্রটি এলাকার রাস্তা ও ফুটপাত ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
চকবাজার থানাধীন কাঁচাবাজারের সামনে ফুটপাত ও সড়কের উপর প্রতিদিন শতাধিক অস্থায়ী দোকান বসে। এসব দোকান থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করা হয়। এছাড়া চক সুপার থেকে ফুলতলা, কেয়ারি থেকে অলি খাঁ, তেলপট্টি থেকে চক সুপার মার্কেট পর্যন্ত সড়কের উপর প্রতিদিন অন্তত শ’তিনেক দোকান বসে। অস্থায়ী দোকানের পাশাপাশি রয়েছে গাড়ির স্ট্যান্ড। এতে শুধু পথচারীদেরই সমস্যা নয়, বরং রাস্তায় গাড়ি চলাচলও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
ধুনিরপুল থেকে রাহাত্তারপুল পর্যন্ত সড়কে ব্যাটারি চালিত টমটমের দৌরাত্ম বহু দিন ধরে। এখানেও রাস্তা দখল করে তৈরি করা হয়েছে স্ট্যান্ড। সকাল থেকে মধ্যরাত অব্দি এসব টমটমের দৌরাত্ম চলতে থাকে। সম্প্রতি এসব স্ট্যান্ড উচ্ছেদে চকবাজার থানা পুলিশ অভিযান চালায়। উচ্ছেদও করে। কয়েকজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারও করে। কিন্ত দিন কয়েকের মাথায় তারা ছাড়া পেয়ে আবারো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এছাড়া টেম্পু স্ট্যান্ডগুলোও রাস্তা দখল করে সংকট প্রকট করে তুলছে। বিশেষ করে অলি খাঁ মসজিদের সামনে থেকে একটি, কেয়ারি মোড় থেকে দুইটি এবং লালচাঁদ সড়কে একটি অবৈধ স্ট্যান্ড এলাকাবাসীর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। মেডিকেলের সামনের ফুটপাত, রাস্তা, চট্টেশ্বরী রোডের মোড়, জয়নগরের রাস্তার মোড়সহ পুরো এলাকায় ফুটপাত ও রাস্তার বিকিকিনি চলছে। চকবাজার থেকে ডিসি রোড, দেওয়ান বাজার থেকে চন্দনপুরা হয়ে আন্দরকিল্লাহ মোড়, আন্দরকিল্লাহ মসজিদের সামনে থেকে লালদীঘি, অন্যদিকে চট্টগ্রাম কলেজের সামনের রাস্তা কোথায় নেই দখলদারিত্ব। প্রতিটি রাস্তা ও ফুটপাত পৃথক পৃথক ব্লকে বিভক্ত করে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। বিভিন্ন গ্রুপ এবং উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে চলছে চাঁদাবাজি।
পাঁচলাইশের কাতালগঞ্জ মোড়ে মাইক্রোবাস ও টেঙি স্ট্যান্ড, ভাসমান দোকান বসিয়ে প্রতিদিনই হাজার হাজার টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। মুরাদপুর মোড়ে গড়ে উঠা টেঙি ও টেম্পো স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে বছরের পর বছর ধরে। এখানে পুরো ফুটপাত দখল করে ভাসমান দোকান বসিয়ে চলছে চাঁদাবাজি। তালিকাভুক্ত একাধিক সন্ত্রাসী পুরো এলাকার রাস্তা ও ফুটপাত দখল বাণিজ্য চালাচ্ছে।
চান্দগাঁও থানাধীন বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের সামনে থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড পর্যন্ত ফুটপাত দখল করে বসানো হয়েছে দোকান। বিভিন্ন ধরনের ফলের দোকান বসিয়ে লাখ লাক টাকা আদায় করা হচ্ছে। একটি দোকান থেকে দৈনিক চারশ’ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয় বলে সরেজমিন অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে। শুধু ফুটপাতই নয়; সড়ক জুড়ে ভ্যান গাড়িতে বসে ভাসমান বাজার। বহদ্দারহাট পুলিশ বঙের সামনের সড়কের এক পাশ দখল করে গড়ে উঠেছে টেম্পো স্ট্যান্ড। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের মোড়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে রাস্তা থেকে দুটি টেম্পো স্ট্যান্ড চলছে। মদিনা হোটেল ও ওয়াপদার সামনে সড়কের উপর পৃথক ভাবে আছে দুটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। চান্দগাঁও থানার পাশেই বহদ্দার বাড়ি মসজিদের সামনে থেকে বলিরহাট পর্যন্ত চলাচলকারী অবৈধ টেঙি স্ট্যান্ড।
শুধু উপরোক্ত এলাকাগুলো নয়, নগরীর প্রায় সর্বত্রই চলছে দখলদারিত্ব। জিইসি মোড়, আগ্রাবাদ, ইপিজেড এলাকাসহ বিস্তুৃত এলাকায় লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য চলছে রাস্তা এবং ফুটপাত নিয়ে। সন্ত্রাসীদের দখলদারিত্বের কারণে কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে বসেছে। ফুটপাত সংস্কারেও কোনো সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সাথে লুকুচুরি খেলছে অবৈধ দখলদাররা। গত সপ্তাহে সুজন বহদ্দারহাট পরিদর্শনে গেলে ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত হয়ে যায়। উনি ফিরে আসার পরপরই জমজমাটভাবে শুরু হয় দখলদারিত্ব। তিনি কোতোয়ালী এলাকায় পরিদর্শনে গেলে কোতোয়ালী মোড়সহ পুরো এলাকা একেবারে ছাফ হয়ে যায়। তিনি ফেরার পরপরই দখলে পসরা সাজানো হয়।