ডাঃ সাদিয়া জাহান:
কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে চিন্তিত এখন পুরো বিশ্ব। সামাজিক, অর্থনৈতিক, চিকিৎসাক্ষেত্র- মানবজীবনের প্রতিটি দিককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে ভাইরাসটি। জীবনের চলার গতিকে থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও আমাদেরকে সাহসী হতে হবে। সচেতনতা এবং সঠিক উদ্যোগের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে মহামারিকালীন এই সময়কে। কীভাবে সচেতন থাকবেন? ঠিক কোন নিরাপত্তাগুলো আপনি গ্রহণ করতে পারেন এসময়? চলুন, এক নজরে কোভিড-১৯ এবং এর প্রতিরোধে যথাযথ নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমগুলো দেখে নেওয়া যাক।
কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস কী?
করোনাভাইরাস বলতে কোন একটি ভাইরাস নয়, বরং কয়েকটি ভাইরাসের একটি মিশ্রণকে বোঝায়। এই ভাইরাস গোত্রটি ছয়টি ভাইরাসকে আক্রমণকারী এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে করা হতো। ‘২০১৯ নভেল করোনাভাইরাস বা এনসিওভি (2019-nCoV)’ এই তালিকায় যোগ হওয়া নতুন এক নাম, যেটি বর্তমানে ক্ষতিকর রূপ ধারণ করেছে।
করোনা ভাইরাসের উৎস কী?
করোনা ভাইরাসের উৎস নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। অনেকে ভাবেন এর উৎস কোন প্রাণী। আবার অনেকে ল্যাবে তৈরী করা কোন ভাইরাসের অংশ ভেবে থাকেন এটাকে। আসলে এই করোনাভাইরাস কী? প্রথম দলটি ভুল ভাবেননি। করোনা ভাইরাসের উৎস প্রাণী। এর আগে সার্স ভাইরাস বাদুড় ও গন্ধগোকুল বিড়াল থেকে ছড়িয়েছিলো।
করোনা মার্স ভাইরাসের উতপত্তিস্থল ছিল উট। বর্তমানে যে করোনাভাইরাস নিয়ে সবাই আশংকায় আছেন সেটি এসেছে দক্ষিণ চিনের সমুদ্রের অংশ থেকে। সেখানে অবস্থিত উহান শহরের পাইকারি বাজারের কোন প্রাণীর কাছ থেকে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। এবারের এই ভাইরাসের উৎস যেমন সামুদ্রিক প্রাণী হতে পারে, তেমনি স্তন্যপায়ী প্রাণীও হতে পারে। ইতিপূর্বে চিনে ২০০২ সালে এবং সৌদি আরবে ২০১২ সালে এই ভাইরাসের আক্রমণ দেখা যায়। এই করোনা ভাইরাসের নাম তখন দেওয়া হয়েছিল যথাক্রমে- ‘সার্স করোনাভাইরাস’ এবং ‘মার্স করোনাভাইরাস’।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কীভাবে হয় এবং এর লক্ষণগুলো কী?
কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাধ্যম হলো মানুষ। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে তিন ফুট দূরত্বের মধ্যে এই ভাইরাস সুস্থ রোগীর শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ধাতব বস্তু, যেমন- দরজার হাতলে এই ভাইরাস ৯ দিন, প্লাস্টিক ব্যাগে ৩ দিন, তামায় ৪ ঘন্টা, কার্ডবোর্ডে ৩ দিন এবং বাতাসে তিন ঘন্টা অবস্থান করতে সক্ষম। আগে থেকেই ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হাঁপানির মতো সমস্যার ভুক্তভোগীরা এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে বেশি থাকেন।
করোনা ভাইরাসের লক্ষণগুলো অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় একটু বেশিই স্বাভাবিক ও সাধারণ। তাই প্রাত্যাহিক এই উপসর্গগুলোকে অনেকেই এড়িয়ে যান। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর শুকনো কাশি শুরু হতে পারে। এক সপ্তাহ এমন চললে একজন ব্যক্তি শ্বাসকষ্ট অনুভব করা শুরু করেন। অনেকের ক্ষেত্রে শরীরে কোভিড-১৯ বিদ্যমান থাকলেও এর কোন উপসর্গ দেখতে পাওয়া যায় না। তাই এইসময় সোশ্যাল ডিসটেন্স বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন।
করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা কী?
করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। নেই কোন টিকা বা ঔষুধও। এমন নয় যে এই ভাইরাসের আক্রান্ত মানুষের সবাই মৃত্যুবরণ করবেন। বিশ্রাম এবং সাধারণ চিকিৎসাতেই ভাইরাসে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যেতে পারেন। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বেশি এমন ব্যক্তির শরীরে কোভিড-১৯ খুব একটা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে না।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার উপায়
করোনাভাইরাস থেকে দূরে থাকতে-
১। কিছুক্ষণ পরপর হ্যান্ড স্যানিটাইজার (৬০% এলকোহল মিশ্রিত) বা সাবান-পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হাত ধুয়ে নিন। পরিবারের অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উৎসাহ দিন।
২। বাইরে থেকে ফিরে পোশাক গরম পানিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। ব্যবহৃত মাস্ক ও টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিন।
৩। প্রতি ২০ মিনিট অন্তর চা, কফি, স্যূপ বা উষ্ণ তরল খাবার গ্রহণ করুন। শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়াতে ইষদুষ্ণ লেবু পানি, সবজি, এবং আয়রনজাতীয় খাবার গ্রহণ করুন।
৪। ঠান্ডাজাতীয় খাবার এবং ধুমপান থেকে বিরত থাকুন।
৫। বাড়ির প্রতিটি স্থান এবং বাড়ির বাইরে থেকে ফেরার পর চশমা ও ঘড়ির মতো জিনিসগুলো ব্লিচিং পাউডার সলিউশন দিয়ে জীবাণুমুক্ত করুন।
৬। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। এতে করে আপনার শরীর জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকবে।
৭। এবং সবচাইতে বড় ব্যাপারটি হলো, এসময় অবশ্যই করোনা আক্রান্ত স্থানে যাওয়া এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ঘরের বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। যদি বাইরে যেতেই হয় সেক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান করে যথাযথ নিয়ম মেনে চলুন।
৮। প্রয়োজন না হলে বাজারে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। অনলাইনে কেনাকাটা করার চেষ্টা করুন। জরুরী ত্রাণের জন্য ফোন করুন ৩৩৩ এই নম্বরে।
৯। বাজার থেকে আনা খাবার বা ব্যাগের ব্যাপারে বাড়তি সতর্করা অবলম্বন করুন। ফল ও শাক-সবজি ভালোভাবে মৃদু গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। রান্নার আগে ও পরে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিন। বাজারের ব্যাগ ফেলে দিন বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করে নিন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিঃ কী করবেন?
আপনার পাশের ব্যক্তিটি কিংবা আপনার মধ্যেও কোভিড-১৯এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। জ্বর, গলাব্যথা বা কাশি দেখা দিলে আতংকিত না হয়ে সচেতনতা অবলম্বন করুন। প্যারাসিটামল এবং লবণ পানি গ্রহণ করুন। গরম পানির ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিন। পরিবারের বাকি সবার থেকে খানিকটা দূরে বা ‘সেলফ আইসোলেশন’এ চলে গিয়ে আলাদা ঘরে অবস্থান করুন। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, শিশু এবং ৬৫ বছরের অধিক বয়সীরা এ ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকেন বিধায় তাদেরকে সুরক্ষিত রাখুন। মনে রাখবেন যে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমন- গ্লাভস, মাস্ক, কাপড়, গামছা ইত্যাদি যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যাবে না বা অন্য কারো ব্যবহার করা যাবে না।
যদি আপনার শরীর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বাড়ির বাকিদের শারীরিক অবস্থাও পর্যবেক্ষণ করুন। অন্যথায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করুন। কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ১০৬৫৫ ও ০১৯৪৪৩৩৩২২২ নম্বরে যোগাযোগ করুন।
কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের মতো সংক্রামক ব্যধিকে পুরোপুরি হারিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি মোট তিনটি। প্রথমত, প্রতিটি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়ে শরীরে এন্টিবডি তৈরি করা, যেটার মাধ্যমে মৃত্যু হতে পারে প্রচুর মানুষের। দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯ এর টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও ব্যবহার করা এবং তৃতীয়ত, যথাযথভাবে লকডাউন মেনে চলে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাইকে সুস্থ রাখা। তাই সংক্রমণের এই সময়টুকু ঘরেই থাকুন। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতিটি মানুষ এবং নিজেকে নিরাপদ রাখতে এটিই বর্তমানে সবচাইতে বড় নিরাপত্তামূলক উদ্যোগ।