এম.এইচ মুরাদঃ
ফাতেমা আক্তার ২০১০ সালে নিজের থাকার ঘরের একটি রুমে ছোট পরিসরে শুরু করেন বিউটি পার্লারের কাজ। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিসর। তারপর বড় পরিসরে দুই রুমের একটা দোকান নেন তিনি। শুরু করেন ব্যবসা। এভাবেই ফাতেমা আক্তার হয়ে উঠেন সফল উদ্যোক্তা। পাশাপাশি তাঁর সেখানেই কর্মসংস্থান হয় আরো পাঁচজন মেয়ের। স্বামীর সাথে মিলে হাল ধরেন ১০ সদস্যের পরিবারের। বেশ ভালোই চলছিলো আট বছর ধরে তাঁর পার্লার ব্যবসা। কিন্তু দুই বছর ধরেই হলো বিপত্তি।
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে গেল বছর পুরো রমজানে বন্ধ ছিল পার্লার। এ রমজানে খোলা হলেও নেই কোনো কাস্টমার। দুই বছর ধরেই লোকসান গুনছেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে তাঁর। পার্লারে কাস্টমার নেই, নিজের হাত খরচও উঠছে না। বিউটিশিয়ান ও দোকান ভাড়া দিচ্ছেন নিজের পকেট থেকে। এভাবেই চলছে তাঁর বর্তমান পার্লার ব্যবসা।
তবে এমন পরিস্থিতিতে শুধু তিনিই নয়, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে লোকসান গুনছেন পার্লার ব্যবসার সাথে জড়িত অন্য নারী উদ্যোক্তাগণও। সরেজমিনে নগরীর বিভিন্ন পার্লারে দেখা যায়, ঈদের দিন ঘনিয়ে আসলেও পার্লারগুলো রয়েছে কাস্টমার শূন্য। পার্লারের ভিতরে শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন বিউটিশিয়ানরা। এবার যেন রূপ সচেতন সেই নারীদের আগ্রহে টান পড়েছে। নেই চুল রিবন্ডিং, ফেসিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিউর কিংবা চুল কাটার হিড়িক। অন্যান্য বছর এ সময়গুলোতে ঈদ উপলক্ষে পার্লারগুলোতে নারীদের বেশ ভিড় থাকতো। এখন অধিকাংশ পার্লারই বন্ধ। যেগুলো খোলা রয়েছে সেগুলোও কাস্টমার শূন্য।
বিউটি পার্লার ব্যবসায়ের সাথে জড়িত নগরীর কয়েকজন উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে যানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীতে ছোট-বড় মিলে প্রায় ১০ হাজারের বেশি বিউটিপার্লার রয়েছে। পার্লারগুলোর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই নারী উদ্যোক্তার। পরিচালনাও করছেন নারীরা। পার্লার ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে লাখো নারী। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এরইমধ্যে প্রায় অর্ধেকের বেশি পার্লার বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ৩০ ভাগ পার্লারও বন্ধ হওয়ার পথে। যার কারণে আবারও নারী বেকারত্বের হার বাড়ছে শহরের মধ্যে।
চট্টগ্রামের কাজির দেউড়ি এলাকায় ভিআইপি টাওয়ারে অবস্থিত অপস্বরী বিউটি পার্লারের স্বত্বাধিকারী রিজিয়া বেগম বুলু বলেন, ‘পার্লার ব্যবসা পরিচালনা ও এর সাথে জড়িত রয়েছে কয়েক হাজার নারী। এ পার্লারগুলোর মধ্যে অনেক নারী নিজ বাসায় কিংবা দোকান নিয়ে বড় পরিসরেও পরিচালনা করছেন ব্যবসা। অনেক নারী এ ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে লোকসান হওয়ায় অনেকে এরইমধ্যে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা যারা এখনো আছি তারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে কোনো রকমে টিকে আছি। এছাড়া পার্লারের কাজের সাথে জড়িত নারীরাও আর্থিকভাবে সংকটে রয়েছেন।
এ সময় তিনি আরো বলেন, পার্লারের কাজ হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু আমাদেরকে বিউটিশিয়ানদের বেতন দিতে হচ্ছে। আমার এখানে ১৮-২০জন বিউটিশিয়ান আছে। এ অসময় যদি আমরা তাদের কাজ থেকে বের করে দিই তবে তাদের কি হবে। তাই বাধ্য হয়ে নিজের পকেট থেকে বিউটিশিয়ানদের বেতন ও বিভিন্ন খরচ দিচ্ছি। তবে এভাবে চললে আমরাও বেশি দিন টিকে থাকতে পারবো না। নারীরা বেকার হলে দেশের উন্নতি বাধার মুখে পড়বে। দেশে আবারও নারী নির্যাতন বাড়বে। সরকার সকল ব্যবসার জন্য মোটামুটি অংকের কিছু অনুদান দিয়েছেন। কিন্তু পার্লার ব্যবসার সাথে জড়িত বৃহৎ নারী গোষ্টির জন্য কিছুই করেনি। আমাদের জন্যও যদি সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু ভাবে তাহলে আমরা নারী উদ্যোক্তাও আবার নিজেদের কাজে ঠিকে থাকতে পারবো বলে আশা করছি।’
চট্টগ্রামের মেহেদীবাগ এলাকায় মেহেদী টাওয়ারের বিপরীতে আনোয়ার ম্যানশনে অবস্থিত ফ্লোরা বিউটি পার্লারের স্বত্বাধিকারী জিনিয়া আক্তার বলেন, আমরা ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা খুবই কঠিন সময় পার করছি। এ পার্লার ব্যবসার পরিচালনা করে বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তা। তাই যদি কাজের ক্ষেত্রে লোকসান হয় তবে আমাদের সেই লোকসান কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না। এ কারণে আমাদের অনেক নারী উদ্যোক্তা হারিয়ে যাচ্ছে।
জিনিয়া আরো বলেন, করোনাকালে সরকার অন্যান্য সকল ব্যবসায়ীদের অনুদান দিয়েছে কিন্তু আমরা নারীরা যারা পার্লার ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের কোনো খবর রাখেনি সরকার। অথচ বেকারত্ব হ্রাসে আমরা নারী উদ্যোক্তারা অর্থনীতিতে অবদান রেখে যাচ্ছি। এসময় তিনি আরো বলেন, আজকে ২৪ রমজান শেষ হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে পাঁচটা কাস্টমারও পাইনি আমরা। তবুও মাস শেষে কর্মকর্তাদের বেতন, দোকান ভাড়াসহ ইত্যাদি নানা খরচ আমাদের দিতে হবে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পার্লারের বিভিন্ন অফার দিলেও নেই কাস্টমার। ফলে এই পেশায় ঠিকে থাকা দিনকে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে আমরা অতিসত্বর অন্যন্য ব্যবসায়িদের মতো মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা আশা করছি।’