এম.এইচ মুরাদঃ
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিপজ্জনক এলাকা এখন চট্টগ্রাম। এক দিনেই ৯৫ জনের শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর দেশের জেলাগুলোর মধ্যে তিন নম্বরে উঠে এসেছে চট্টগ্রাম।
অনিয়ন্ত্রিত চলাচল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রায় উন্মুক্ত থাকার কারণে চট্টগ্রামে করোনা ভাইরাসের বিস্তার দ্রুত ঘটছে। এ জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় ৫০০ জনেরও বেশী করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর মধ্যে গতকাল ভোর ছয়টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয় ৯৫ জন। এক দিনেই রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
গত ২৫ মার্চ থেকে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর গত ২৬ এপ্রিল থেকে শুরু হয় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা। চলতি সপ্তাহ থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পরীক্ষাগারে কোভিড-১৯ রোগ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বাড়ায় এই অঞ্চলে বেড়ে চলেছে রোগী শনাক্তের সংখ্যাও।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আন্তজেলা ও আন্তউপজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত সচল থাকায় চট্টগ্রামে ঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষ করে মহাসড়ক দিয়ে পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী পরিবহন হচ্ছে। মাইক্রোবাস ও গাড়িও চলছে। এতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকজন আসছেন। এ কারণে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর বিপজ্জনক হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় করোনা রোগী ৯৭২ জন।
চট্টগ্রামে ৫০০ এর বেশী রোগীর মধ্যে মৃত ২৪ জন। সুস্থ ১০১ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা না মেনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের লোকজন চট্টগ্রামে যাতায়াত করছে। পোশাক কারখানা চালু হওয়ার কারণে কর্মীরা চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। নারী-পুরুষ গোপনে মালবাহী ট্রাক, মাইক্রোবাস, কাভার্ড ভ্যানে চড়ে আসছেন। পুলিশের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় মহাসড়ক বা নগরে আগের মতো কড়াকড়ি অবস্থা নেই।
পাল্টে যাচ্ছে চিত্র:
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় ১ মে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৩২৬ জন। পরদিন ২ মে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৮ জনে। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে ১২ মে করোনা রোগী তিন গুণ বেড়ে ৯৭২ জন শনাক্ত হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগর ও জেলার রোগীর সংখ্যা ৫০০ এর বেশী।
চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, ১২ মে চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় সর্বোচ্চ ৯৫ জন শনাক্ত হয়েছেন। এ কারণে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর চট্টগ্রাম শনাক্তের দিক থেকে সারা দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে।
আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১২ মে পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় ৭ হাজার ৬৮৪ এবং নারায়ণগঞ্জে ১ হাজার ২৮৬ জন শনাক্ত হন।
গত ২৫ মার্চ থেকে চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ রোগ শনাক্তের পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের আট জেলার নমুনা পরীক্ষার প্রথম আট দিন কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। নবম দিনে তথা ২ এপ্রিল চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকার এক বৃদ্ধের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। তাঁর সৌদিফেরত মেয়ের মাধ্যমে তিনি সংক্রমিত হন বলে চিকিৎসকেরা জানান।
চট্টগ্রামের বিআইটিআইডি হাসপাতালের ল্যাব প্রধান ও মাইক্রোবায়োলজির সহযোগী অধ্যাপক শাকিল আহমেদ বলেন, এপ্রিল পর্যন্ত কড়াকড়ি অবস্থা ছিল। মানুষ ঘর থেকে কম বের হয়েছে। তাই শনাক্তের সংখ্যা ও হার অনেক কম ছিল। তিনি বলেন, এখন সব ঢিলেঢালাভাবে চলছে। এতে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের (গোষ্ঠী সংক্রমণ) দ্রুত বিস্তার ঘটছে।
হাসপাতালে শয্যা:
চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত করোনা চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে ২২০টি শয্যা প্রস্তুত আছে। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যা মোট ১০টি, যা চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে। জেনারেল হাসপাতালে ১০০ শয্যার আইসোলেশন ও ১০ শয্যার আইসিইউ ওয়ার্ড ছাড়াও ফৌজদারহাটের বিশেষায়িত হাসপাতাল বিআইটিআইডিতে ৩০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড এবং একই এলাকায় অবস্থিত ফিল্ড হাসপাতালে ৫০ শয্যা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০ শয্যার অবজারভেশন ওয়ার্ড আপাতত ব্যবহার করা হচ্ছে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি জানান, করোনায় সংক্রমিত ১০ থেকে ২০ শতাংশ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন। বাকি রোগীরা বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ফজলে রাব্বি আরও জানান, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে এই মুহূর্তে ৭৬ রোগী চিকিৎসাধীন। হাসপাতালটিতে আরও আসন খালি আছে। তবে যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া আছে।
চট্টগ্রামে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়া ৪১৭ রোগীর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০১ জন। আর মারা গেছেন ২৪ জন।
ঠেকানোর উপায়:
করোনা বিস্তার রোধের জন্য বিশেষজ্ঞরা যাতায়াতব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেও পরামর্শ দেন তাঁরা। নইলে বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, যাতায়াত তথা আন্তজেলা এবং আন্তউপজেলা গাড়ি চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, জরুরি কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া, অথবা বের হলে মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষের পরামর্শ, সংক্রমিত ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আইসোলেশনে অবশ্যই থাকতে হবে। এভাবে নিয়ম মেনে চললে করোনার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।