মেজবাহ খালেদঃ
সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের কয়েকশ একর এলাকায় গত দেড় যুগ ধরে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের অবৈধ বসতি। চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদে’র নেতৃত্বে সরকারি খাস জমিতে গড়ে তোলা এই ঝুঁকিপূর্ণ বসতি এখন পরিণত হয়েছে ছিন্নমূলের দুর্ভেদ্য সাম্রাজ্যে । যদিও এ এলাকা সীতাকুণ্ডের একটা অংশ তবে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে হয় চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ থানার বাংলাবাজার এলাকা দিয়ে। বাংলাবাজার এলাকা থেকে গর্তে ভরা সড়ক ধরে চার কিলোমিটার পর্যন্ত যাওয়া যায়। এরপর ডান দিকে নেমে গেছে পাহাড়ি মাটির পথ। ওই উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে এক কিলোমিটারের মত এগোলে দেখা মিলবে ছিন্নমূলের বসতির। রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে আধাপাকা মাদ্রাসা ও টিনের ঘর। খালি প্লটে আছে জমির ‘মালিকের’ নাম লেখা ছোট ছোট বহু সাইনবোর্ড।
এই পথ ধরে আরও এক কিলোমিটার গেলে একটি লোহার তোরণে পৌঁছানো যায়। যদিও ২০১০ সালের জুনে এই লোহার তোরণের জায়গায় একটি পাকা গেইট ছিল। থাকে ছিন্নমূলের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীরও । তোরণ পেরিয়ে আধা কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই একটি মসজিদ ও মাঠ। আশেপাশে দোকানপাট, এটি ছিন্নমূলের বাজার এলাকা। বাজার থেকে সোজা একটি এবং বাঁয়ে আরেকটি সড়ক চলে গেছে। বাঁ পাশের সড়কটি ধরে এগোলে পড়বে এস এম পাইলট স্কুল।
সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের আলিনগরে যে সংগঠনের নাম দিয়ে অবৈধ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল সেটির নাম চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ । আর এ সংগঠনের সভাপতি গাজী সাদেকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক কাজী মশিউর রহমান। যদিও কাজী মশিউর রহমান এখন জেলে।
বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, সমিতির সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ২৭ হাজার। ৯ হাজার পরিবারে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস সেখানে। পুরো এলাকাকে ১১টি সমাজে ভাগ করা হয়েছে ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য।
স্থানীয়রা জানায়, খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, নোয়াখালীর সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, খুন-গুম মামলার আসামিরাই সলিমপুরের আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রাতের বেলা দূরে থাক, দিনেও যেতে আতংকে থাকেন। এখানে সীতাকুন্ডের স্থায়ী বাসিন্দা হাতেগোনা। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অপরাধীরা এসে আস্তানা গড়ে তোলে জঙ্গল সলিমপুর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আর তারা জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় খুন, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসার পাশাপাশি এসকেভেটর দিয়ে বিশাল বিশাল পাহাড় কেটে প্লট ও মাটি বিক্রির কাজ করে থাকে।
জানা যায়, সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুর ১নং ওয়ার্ডে মোট ভোটার প্রায় ৭ হাজার ৮শ। এই বিশাল ভোটারের এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অপরাধ করে আসা দাগি আসামি। তারাই জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় ত্রাশের রাজত্ব কায়েম করছে। নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ার মাধ্যমে তারা নিয়ন্ত্রণ করে জঙ্গল সলিমপুরকে। যেমন জঙ্গল সলিমপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে সাবেক ইউপি সদস্য গোলাম গফুর ও গাজী সাদেকের নেতৃত্বে খুন, গুম ও ডাকাতিসহ একাধিক মামলার আসামি মশিউর ও রিপন। আর আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করে বড় রাজা মোহাম্মদ ইয়াসিন ও ছোট রাজা মোহাম্মদ ফারুক। এভাবে একাধিক বাহিনী বিভিন্ন নামে এই জঙ্গল সলিমপুর নিয়ন্ত্রণ করে।
সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসের তথ্যমতে, জঙ্গল সলিমপুর মৌজার ১ নম্বর খাস খতিয়ানের বিএস ২০১ দাগে ১৮ দশমিক ৭৭ একর, ২০৩ দাগে ৪৩২ দশমিক ৯৯ একর, ২১২ দাগে ০ দশমিক ০৭ একর, ২৬২ দাগে ৩ দশমিক ৭০ একর, ২৭৮ দাগে ৩৯ দশমিক ৬৫ একর, ৩৫০ দাগে ২০০ দশমিক ১০ একর, ৩৫১ দাগে ৪৮ দশমিক ৫০ একর, ৩৫২ দাগে ৩ দশমিক ৪০ একর, ৩৫৫ দাগে ৭৪ দশমিক ৭৫ একর, ছুট খতিয়ানের ৩০৯, ৩৪৯, ৩০৭ দাগ ও ১৯ নম্বর খতিয়ানের বিএস শ্রেণি পাহাড়, ২০২ দাগে ০ দশমিক ৯৯ একর ছড়া এবং ২১২ দাগে ০ দশমিক ০৭ একর শ্রেণি নাল থাকার কথা। কিন্তু ৪০টির বেশি পাহাড় কেটে ওখানে তৈরি করা হয়েছে অন্তত ২০ হাজার প্লট।
এর মধ্যে আলীনগর এলাকার প্লটগুলো ৫-১০ লাখ টাকায় বিক্রয় করে ইয়াসীন বাহিনী। জঙ্গল সলিমপুর এলাকার প্লট বিক্রি করে মশিউর বাহিনী। ছিন্নমূল এলাকায় প্লট বিক্রি করে কাউছার বাহিনী। যেখানে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বসতি গড়ে তুলছে দেশের খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর, ঢাকা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীর দাগী অপরাধীরা। একইভাবে আশ্রয় নিচ্ছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারাও। আর এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ইয়াবা, আইস, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ মাদক বিক্রির হাট। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতির উৎসস্থল হিসেবেও পরিচিত এই জঙ্গল সলিমপুর।
অভিযোগ রয়েছে, সন্ত্রাসীরা জঙ্গল সলিমপুরে বাস্তুহারা লীগ, কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ছিন্নমূল বস্তি সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ ও ইসলামপুরে সমাজকল্যাণ সমিতির নামে সরকারি জায়গা দখল করছেন। ইসলামপুরের নেতৃত্বে রয়েছেন শাহজাহান বাদশা, আবদুল মালেক প্রমুখ।
এলাকার ভেতরে আছে ১২টি মসজিদ, চারটি মাদ্রাসা, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, তিনটি কেজি স্কুল, তিনটি এতিমখানা, ছয়টি কবরস্থান, পাঁচটি মন্দির, দুটি কেয়াং, গির্জা, শ্মশান এবং কাঁচা বাজার ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সমিতির সদস্যপদ নিতে হয় টাকা দিয়ে। পরে সমিতিকে টাকা দিয়ে পাহাড়ের ভেতরে একেক খণ্ড জমির দখল নিয়ে ঘর তুলেছেন তারা। আর এভাবে অবৈধভাবে ২০০৪ সাল থেকে তাদের এই বসবাস শুরু হয়েছে।যদিও ২০০৬ সালে একবার সরকারি এই জমির বন্দোবস্তি চেয়ে আবেদন করেছিল তারা । এরপর ২০১৬ সালে ছয়শ একর জমির বন্দোবস্ত চেয়ে আবার আবেদন করে। যদিও সরকারি জমি এভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ার সুযোগ নেই বলে এই আবেদন বাতিল করে প্রশাসন।
এর মধ্যে পাহাড়ে এই অবৈধ বসতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০০৪ সালে একাধিক পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ২০১০ সালে স্থানীয় লাল বাদশা ও আলী আক্কাসের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ওই এলাকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন সংবাদকর্মীরা। ২০১০ সালের ২৩ মে র্যা বের সঙ্গে কথিত ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ আলী আক্কাস নিহত হন।
প্রশাসনের চোখের আড়ালে পাহাড়ে বসবাস অনুপযোগী হয়া সত্ত্বেও এখানে মানুষ অবৈধভাবে ঘর তুলে তুলে চূড়ায় চলে গেছে। এখানে হাজার হাজার পরিবার, কোনো বৈধতা নেই। তারা দেখছে- ঘর বানালে, বসবাস করলে কোনো বাধা নেই; এজন্যই এটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেছে। এটা বসবাসযোগ্য না বা গ্রাম বানানো বা বাজার -শহর বানানোর জায়গা না থাকলেও সব হয়েছে। এখানে বিদ্যুৎ আসার কথা না থাকলে তথাকথিত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অবৈধভাবে তা এসেছে।
আক্কাসের পর্ব শেষ হলে আসে ইয়াসিন। যদিও তখন ইয়াসিনকে আড়ালে রেখে মসিউর একক আধিপত্য চালিয়ে যায়। শীর্ষ সন্ত্রাসী মশিউর এলাকায় চাঁদাবাজি, সরকারি খাস জমি ও পাহাড় কেটে প্লট আকারে লোকজনের কাছে বিক্রয় করত। সিঙ্গেল প্লট ৩ থেকে ৪ লাখ টাকায় ও ডাবল প্লট ৬ লাখ টাকায় বিক্রি করত তারা।
এক সময় জঙ্গল সলিমপুরে নিজের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বড় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে। এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবসময় সুযোগ হয়না সলিমপুরে অভিযান পরিচালনা করার। আর সেই সুযোগে মশিউর ও তার বাহিনীর লোকজন এলাকাটিতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। পাহাড়ের ওই বসতি নিজম্ব বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখেন মশিউর। পাশাপাশি চাঁদাবাজি, জায়গা দখলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজেও যুক্ত সে। মশিউর আগে খুলনার চরমপন্থি দলের সদস্য ছিল। খুলনায় অনেক মামলা হওয়ার কারণে সে পালিয়ে চট্টগ্রাম আসে। এখানে আসার পরে শিবলুকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিত মশিউর। এরমধ্যে গত ডিসেম্বরে সীতাকুণ্ডে পাহাড়ের অবৈধ বসতি নিয়ন্ত্রণে রেখে চাঁদাবাজি, খুন ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মামলায় জামিনে থাকা কাজী মশিউর রহমানকে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার করে র্যা ব । যদিও এর আগে ২০১৭ সালে সে গ্রেপ্তার হয়। জামিনে বের হয়ে আবার ‘এলাকায়’ সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছিল সে।
২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর র্যা বের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন মশিউর। তখনও তার বাসা থেকে বিদেশি পিস্তলসহ ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র্যাসব ।
গত দেড় যুগ ধরে কয়েকশ একর এলাকায় পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে ৩০ হাজার মানুষের অবৈধ বসতি। সমিতির নামে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘দুর্ভেদ্য সাম্রাজ্য’। দুর্গম ওই এলাকায় প্রশাসনের খুব একটা প্রভাব না থাকায় গ্রেপ্তার এড়াতে বড় বড় সন্ত্রাসীরাও সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয় বলে স্থানীয়দের ভাষ্য। এখানে সরকারি বিদ্যুৎ নেওয়ার জন্য মশিউর বাহিনীকে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। বিদ্যুৎ বিল যা আসে তার থেকে সাধারণ মানুষকে বেশি টাকা দিতে হয়। মশিউর বাহিনী ২০১০ সাল থেকে জঙ্গল সলিমপুরে এসব কাজ করে আসছিল। পাহাড় কেটে ও খাস জমি অবৈধভাবে দখল করে প্লট আকারে বিক্রি করত। এই বাহিনী এভাবে প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার প্লট বিক্রি করেছে।মশিউর গ্রেফতার শেষে তার কথিত পুত্র শিবলুর হাতে ক্ষমতা যায় । মশিউর জেলে যাওয়ার পর তার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে গ্রুপ পরিচালনা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মশিউর গ্রুপের বাকি সদস্যরা শিবলুকে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মশিউর জেলে যাওয়ার পরে শিবলু চেষ্টা করে বাহিনীটিকে পরিচালনা করার জন্য।
এর মধ্যে সলিমপুরে সন্ত্রাসী মশিউরের আস্তানায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালায় র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ( র্যা ব ) এবং সেদিন পাঁচজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের শুরুতেই সলিমপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী মশিউরের ছেলে শিবলুর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা প্রথমে র্যা বকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল, লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা করে আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে পাহাড় থেকে র্যাশবকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এই পরিস্থিতিতে র্যাাবও পাল্টা গুলি করে। তারই একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। নিজেদের জীবন ও উদ্ধার করা অস্ত্র রক্ষা করার জন্য র্যাীবকে ১২৯ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করতে হয় বলে জানিয়েছেন র্যারব অধিনায়ক। সেদিন গ্রেপ্তার ৫ জন হন- রফিকুল ইসলাম মালু ( ৪১), মো. সিরাজুল ইসলাম ( ৩৪), মো. হাসান ( ৩৫) জামাল শেখ ( ৪৭) ও মিজানুর রহমান। র্যা ব সূত্রে তখন জানা যায়, মশিউর গ্রেপ্তারের পর থেকে এই পাঁচজন গ্রুপটি পরিচালনা করে আসছিল। সেদিন তাদের আস্তানা থেকে ১০টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, ১টি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও মোট ২২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও তাদের আস্তানা থেকে মিলিটারি গেজেট, মিলিটারি পোশাক, মিলিটারি বাইনোকুলার ও অবৈধ মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের থেকে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার রিসিট উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তার রফিকুল ইসলাম মালুর বিরুদ্ধে বায়েজিদ থানায় ১টি, মো. সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ৫টি অস্ত্র মামলা, মো. হাসানের বিরুদ্ধে ৭টি, জামাল শেখের বিরুদ্ধে ১০টি ও মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন থানায় ১০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। মশিউর জেলে যাওয়ার পরে ওই বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছে জামালও। এছাড়া মশিউরের ছেলে শিবলুর বিরুদ্ধে ১০টি মামলা আছে।
এরপর শিবলু আড়ালে চলে গেলে নেতৃত্ব তুলে নেয় ইয়াসিন এবং ফারুক। যদিও ওরা আগে থেকেই নেতৃত্বে ছিল তবে তারা আড়ালে থাকতো । এক সময় আরো হিংস্র হয়ে উঠে ওরা। জঙ্গল সলিমপুরের সরকারি খাস জায়গার উপর দুর্গম পাহাড় কেটে গড়ে তোলে এক দুর্ভেদ্য সাম্রাজ্য। এখানে প্রবেশের আগে অনুমতি নিতে হয় মোহাম্মদ ইয়াসিন ও মোহাম্মদ ফারুকের কাছ থেকে । দেশের বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও নানা অপরাধে জড়িতদের এখানে এনে আশ্রয় দেয় এই ইয়াসিন ও ফারুক। সন্ত্রাসীরাও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এখানে এসে বসবাস শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খাতায় নাম রয়েছে এরকম দাগী অনেক আসামি এখানে রয়েছে বলেও জানা যায়। জঙ্গল সলিমপুরের সন্ত্রাসীরা বাইরে নানা অপরাধ করে আবার ফিরে আসে। এখানে যেকোন ঘটনার মীমাংসা করেন ইয়াসিন এবং ফারুক। তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ থানায় বা অন্য কোথাও অভিযোগ দিতে পারেনা।
পুলিশের তথ্যমতে, ইয়াসিনের বাবা নোয়াখালীর সুবর্ণচরের বাসিন্দা শামসুল হক ছিলেন একজন সিএনজি চালক। কয়েক বছর আগে ছোট ভাই ফারুককে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আসেন। ইয়াসিন নিজেও প্রথমে কিছুদিন সিএনজি অটোরিক্সা চালান। এরপর আমিন জুট মিল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এরপর চট্টগ্রাম এসে প্রথমে একটি ভাড়া ঘরে বসবাস করেন কিছুদিন। এর কিছুদিন পর সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুরের পাহাড়ি এলাকার একটি ভাড়া ঘরে বসবাস শুরু করে দুই ভাই। প্রথমে নোয়াখালীর চিহ্নিত কিছু সন্ত্রাসী ও দাগী আসামিদের এনে আশ্রয় দেন সেখানে। দীর্ঘদিন যাবৎ সে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে আলীনগর গ্রামে বসবাস করার সুবাদে সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে। বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হত্যা, ধর্ষণসহ বহু মামলার আসামি সে। এরই মধ্যে কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছে। কয়েকদিন কারাভোগ করে জামিনে বেরিয়ে আসে। ইয়াসিন বাহিনীর ক্যাডাররা একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। বেশ কয়েকটি মামলা চলমান এবং কিছু মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এ ছাড়াও পাহাড়ের কাঠ পাচার অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সে। একসময় পার্শ্ববর্তী দুর্গম পাহাড়ের একটি অংশ কেটে বিক্রি শুরু করে তারা। তাতেই রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। নিজেরা পাহাড়ে গড়ে তোলে নিজেদের আলাদা সাম্রাজ্য জঙ্গল সলিমপুর । জানা গেছে, অনেক সন্ত্রাসী খুন করে এখানে এসে আশ্রয় নেয় ।
সরকার পুরো জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে একটি বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং তা প্রকাশ্যে আসলে এতে তারা নড়েচড়ে বসে এবং নিজেদের আধিপত্য হারানোর ভয় কাজ করে। সম্প্রতি জঙ্গল সলিমপুরের সরকারি খাস খতিয়ানের ২ হাজার একর জায়গা নিয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। সেখানে স্পোর্টস কমপ্লেক্স, কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর, আইকনিক মডেল মসজিদ, জাতীয় তথ্যকেন্দ্র, নভো-থিয়েটার ও ইকোপার্ক করার পরিকল্পনা নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে তথ্যমন্ত্রীসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য, সিটি মেয়র ও সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ দফায়-দফায় উক্ত এলাকা পরিদর্শন পরিদর্শন করলে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ।
সরকারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১৫ জুলাই শুক্রবার স্থানীয় সরকার চট্টগ্রাম বিভাগের উপ পরিচালক বদিউল আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল আহসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মাসুদ কামাল, সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহাদাত হোসেন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) মং মারমা ও সীতাকুণ্ড উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম ও সলিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আজিজ জঙ্গল সলিমপুর / আলীনগর পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে চেয়ারম্যানের গাড়ি থেকে নামিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্যকে মারধর করে ইয়াসিন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তাদের সামনে জনপ্রতিনিধিকে মারার ঘটনা সরকারের বিরুদ্ধে স্পষ্টত অবস্থান। তাছাড়া এখানে তারা বার্তা দিতে চেয়েছে যে এখানে কারো প্রবেশ নিষেধ।
অবশেষে জঙ্গল সলিমপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে একজন জনপ্রতিনিধিকে পিটিয়ে আলোচনায় এসেছেন এলাকার ত্রাস হিসেবে খ্যাত ইয়াসিন। গতকাল ( ১৮জুলাই) তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টাকে ছোট করে দেখতে চায় না এলাকাবাসী। কারণ এলাকাটি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। মাদক কারবার, খুন-গুম থেকে শুরু করে হেন কোন অপরাধ নেই সেখানে সংগঠিত হয় না। এসব অপরাধে জড়িত জঙ্গল সলিমপুর দখল ও নিয়ন্ত্রণে রাখা অপরাধী চক্র। গ্রেপ্তার হওয়া ইয়াসিন এ চক্রেরই একজন। এ চক্র জঙ্গল সলিমপুর ঘিরে সরকারের মহাপরিকল্পনাকে ভালো চোখে দেখছে না। তাই ইউপি মেম্বার আরিফের হামলাকে ছোট করে দেখতে চায় না স্থানীয় লোকজন। তাদের মতে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ইয়াসিন হয়ত জঙ্গল সলিমপুর নিয়েই একটা বার্তা দিতে চেয়েছে।
সীতাকুন্ড মডেল থানার ওসি (তদন্ত) সুমন বনিক জানায়,শীর্ষ সন্ত্রাসী ইয়াছিন তাঁদের হাতে গ্রেপ্তার হলেও ইউপি সদস্যকে মারধরের মামলায় অভিযুক্ত আসামি ফারুক, সজীব, নুরুল ইসলাম, শাহজাহান ও আল আমিন সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারিক হাকিম বেগম নাজমুন নাহারের আদালতে স্বেচ্ছায় জামিন নিতে যান। পরে আদালত তাঁদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠান।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন জানান, জঙ্গল সলিমপুরের পাহাড়ের বেশ কিছু পাহাড় দখল করে নিজের অপরাধের স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছিল সন্ত্রাসী ইয়াছিন। আর তাঁর রাজ্যে বহিরাগতের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে গড়ে তুলেছেন বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। গত শুক্রবার জঙ্গল সলিমপুর এলাকা পরিদর্শন শেষে তাঁরা ফেরার পথে তাঁদের গাড়িবহরের পেছনে থাকা ইউপি চেয়ারম্যানের গাড়ির গতিরোধ করে ইউপি সদস্য আরিফকে নামিয়ে নেন। এ সময় আরিফকে মারধরের পাশাপাশি তাঁর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ না করতে হুঁশিয়ারি দেন। যার প্রেক্ষিতে আজ বিকেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।