স্টাফ রিপোর্টার:
নিরীক্ষা আপত্তির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বিষয়ে ‘সালিশে’ (আর্বিট্রেশন) যাওয়ার জন্য দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “জিপি সিঙ্গাপুরের একটি ল ফার্মের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিস দিয়েছে আর্বিট্রেশনে যাওয়ার জন্য। আমি মনে করি যে এটি খুব দুঃখজনক। বাংলাদেশে ব্যবসা করবে একটি প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিস দিয়ে আর্বিট্রেশনের জন্য চাপ দেবে, এটা বোধহয় খুব সহজে গ্রহণ করার মত অবস্থা না।”
এ বিষয়ে জানতে গ্রামীণফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পাওনা চেয়ে গত এপ্রিল মাসে চিঠি দিয়েছিল টেলিযোগাযাগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। তাতে কাজ না হওয়ায় আরোপ করা হয় কড়াকড়ি।
গ্রামীণফোনের পাশাপাশি ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনার দাবিতে আরেক অপারেটর রবির ক্ষেত্রেও বিটিআরসি একই পদক্ষেপ নেয়। বিটিআরসি সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তিতে রাজি না হওয়ায় দুই অপারেটর আদালতে হয়।
মীমাংসার উদ্যোগে নিয়ে অর্থমন্ত্রী গ্রামীণফোন ও বিটিআরসির কর্মকর্তাদের নিয়ে দুই দফা বৈঠক করলেও তাতে সমাধান আসেনি।
বিটিআরসির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার নিরীক্ষা দাবির নোটিসের ওপর হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে গত ২৪ নভেম্বর গ্রামীণফোনকে অবিলম্বে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রবির নিরীক্ষা আপত্তির বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারধীন। টেলিকম খাতের প্রতিবেদকদের সংগঠন টেলিকম রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের (টিআরএনবি) সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়ে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেন, “আমরা এটা বুঝি, ব্যবসা যদি কেউ করে, তাহলে ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা থাকবে, আমাদের দায়িত্ব ফেসিলেটেট করা, আমরা তাদের করব।”
গ্রামীণ ফোনের উকিল নোটিসের বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নেবে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “যে নোটিস দেওয়া হয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অবহিত করা আছে। সবাই বিষয়টাকে জানে।”
এ বিষয়ে আইনজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই উকিল নোটিস নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এর কারণটা হচ্ছে তারা যে জায়গায় চাচ্ছে, সে জায়গাটা হচ্ছে আর্বিট্রেশন যেন করা হয়। আর্বিট্রেশন করার জায়গায় আমরা উম্মুক্ত আছি। বাংলাদেশের আদালতে মামলা করে বসে থাকে, আদালতের বাইরে আর্বিট্রেশন করার সুযোগ নাই।
“আদালত যদি হুকুম দেয় আর্বিট্রেশন করার, তাহলে করতে পারব। যে দেশে বিজনেস করে সে দেশের আইন আদালত অমান্য করে দুনিয়ার কোনো জায়গায় গিয়ে অন্য বিচার পাওয়ার সম্ভবনা নাই। আমরা সঠিক পথে আছি, আদালত তার দৃষ্টিভঙ্গি চমৎকারভাবে করেছে।”
গ্রামীণফোন আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কোনো উদ্যেগ নিচ্ছে কিনা- সেই প্রশ্নও সাংবাদিকরা মন্ত্রীকে করেছিলেন।
উত্তরে তিনি বলেন, “তারা এরকম একটি ধারণা দিয়েছে যদি আর্বিট্রেশন না হয় তাহলে আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে। তবে আমার যেটা অবজারভেশন, বাংলাদেশের আদালতে হেরে গিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে কিছু একটা করা যাবে আমি এটা বিশ্বাস করি না। “আফটার অল, দিনের শেষে অংকটা সহজ, ব্যবসাটা বাংলাদেশেই করতে হবে, বাংলাদেশের আইন কানুন না মেনে আন্তর্জাতিক আদালত বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা করে দেবে না।”
এই বিরোধ নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে মোস্তাফা জব্বার বলেন, “আমরা সহানুভতিশীল, আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। আমরা সমস্যার সমাধান করার জন্য সব ধরনের উদ্যেগ নিতে প্রস্তুত। কিন্তু এর মধ্যে থেকে কেউ জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন করতে চাইলে আমরা সেটি করতে পারি না।”
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট গ্রামীণফোনের বিষয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা মেনে চলা হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “রবি ইতোমধ্যে প্রস্তাব দিয়েছে মামলা তুলে নিতে চায়। আমরা বলেছি আমরা তো মামলায় যাইনি, ওরা যদি মামলো তুলে নিলে আলোচনায় বসতে কোনো আপত্তি নেই। তবে মামলা চলাকালীন অবস্থায় আলোচনা করতে পারি না, কারণ সেটি আদালত অবমাননা হয়ে যাবে।”
আর গ্রামীণফোন যতক্ষণ না আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করছে, ততক্ষণ তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসা সম্ভব না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “এ টাকা দেওয়ার পর আদালত নির্ধারণ করবে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। রবি যদি মামলা প্রত্যাহার করে আসে, তাহলে আলোচনায় বসতে রাজি আছি।”
দেশে গ্রাহকের হাতে থাকা ১৬ কোটি ৪১ লাখ নিবন্ধিত মোবাইল সিমের মধ্যে ৭ কোটি ৬০ লাখ সিম গ্রামীণফোনের। আর রবির ৪ কোটি ৮৩ লাখ সিম রয়েছে গ্রা্হকের হাতে। এই হিসাবে দেশের মোট গ্রাহকের ৪৬.৪৯ শতাংশই গ্রামীণফোনের সেবা নিয়ে থাকেন।
দেশের ৯ কোটি ৯৫ লাখ ইন্টারনেট গ্রাহকের মধ্যে ৯ কোটি ৩৭ লাখই মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা মোট গ্রাহকের ৯৪ শতাংশের বেশি।
মোবাইল ফোন সেবা খাতে গ্রামীণ ফোনই বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একমাত্র কোম্পানি। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণফোনের বাজার মূলধন ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের প্রায় ১২ শতাংশ।