আকবর চৌধুরীঃ
কাল ঈদ। ঝুঁকি অনেক। সময়ও অনেকটা শেষ। কিন্তু নাড়ির টান যে বাধা মানে না। বাড়ি ফিরতেই হবে। সব মিলে তাই ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। একদিন আগে গতকাল সোমবারও তাই ঢাকার প্রধান সড়কে ছিল প্রচণ্ড যানজট। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ বাড়িফেরা এসব মানুষ। ঈদে বাড়ি যাচ্ছি। এটাই খুশির। দুঃখ নেই। রাজধানীর বনানী হয়ে বিমানবন্দর এলাকা দিয়ে যেসব গাড়ি টঙ্গী ও গাজীপুরে প্রবেশ করেছে সেসব গাড়ির যাত্রীদের পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। এ সড়কে সকাল ৮টা থেকে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় গাড়িতে বসে কাটাতে হয় যাত্রীদের। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া অতিরিক্ত গাড়ির চাপে এ যানজট দেখা দেয়। এদিকে ঈদ যাত্রায় বিভিন্ন পরিবহনে যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।
মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়ায় ঈদে ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড় ও যানবাহনের চাপ লক্ষ্য করা গেছে। শিমুলিয়া ঘাটে দুটি কন্ট্রোল রুম বসিয়েও লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না পুলিশ। কোভিডের ঝুঁকির মধ্যে উত্তাল পদ্মা পার হতে তিন কিলোমিটার ঘুরে চলছে সেখানকার সব ফেরি। এতে অতিরিক্ত সময় ফেরিতে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের সহ-মহাব্যবস্থাপক মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, উত্তাল পদ্ময় ফেরি চলতে সমস্যা হচ্ছে। তীব্র স্রোতের কারণে সব ফেরি চলতে পারছে না।
অন্যদিকে স্রোত ও পানি বাড়ায় তিন-চার কিলোমিটার ঘুরে চলছে ফেরিগুলো। এতে ফেরি যাওয়া-আসায় সময় লাগছে বেশি। ফলে ফেরির ট্রিপ কমে যাচ্ছে। এ কারণে ঘাটে গাড়ির জট লাগছে। শিমুলিয়া ঘটেই পণ্যবাহী ট্রাকসহ অর্ধসহস্রাধিক গাড়ি আটকা পড়েছে। এখানে এখন ১৬টি ফেরি আর ৮৬টি লঞ্চ চলাচল করছে বলে তিনি জানান।
ওদিকে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলার কথা থাকলেও গতকাল সোমবার সকালে দেখা গেছে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে লঞ্চগুলো। লঞ্চ ঘাটে পা ফেলার জায়গা নেই। আর ফেরিতে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকছে যাত্রীরা। লঞ্চ, ফেরি কোথাও কোনো রকম স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই।
মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ি ইনচার্জ পরিদর্শক মো. সিরাজুল কবির বললেন, পদ্মার প্রবল স্রোতে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে ছোট আকারের লঞ্চগুলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে সকালে ঘাটে পুলিশ দুটি কন্ট্রোল রুম বসিয়েছে। তবু যাত্রীদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
সরেজমিন দেখা যায়, টার্মিনালে লঞ্চ নোঙর করা মাত্রই অপেক্ষমাণ যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে লঞ্চে প্রবেশ করছেন। তাদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে যানবাহনের যাত্রীদের ফেরি পার হতে ঘাটে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। পারের অপেক্ষায় থাকা ট্রাকগুলো একদিন ধরে পারের অপেক্ষায় আছে। পার হতে না পেরে দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
মাওয়া ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) মো. হাফিজ জানিয়েছে, শিমুলিয়া ঘাটে ফেরি পারের অপেক্ষায় আছে পাঁচ শতাধিক যানবাহন। এর মধ্যে প্রাইভেট কার ও ট্রাকের সংখ্যাই বেশি আছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, পশুবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী গাড়িগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে পার করা হচ্ছে। ঈদের যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুই শতাধিক ট্রাক আটকে রাখা হয়েছে। এসব ট্রাক ধীরে ধীরে শিমুলিয়া ঘাটের দিকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।
শিমুলিয়া নদী বন্দরের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক ও সহকারী বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. শাহাদাত হোসেন জানিয়েছেন, শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার এবং শরিয়তপুরের মাঝিকান্দি নৌপথে ৮৭টি মধ্যে ৮৬টি লঞ্চ চলাচল করছে। লঞ্চে যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি লঞ্চগুলো যাতে নির্দেশনা মেনে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী বহন করে সে বিষয়টিও দেখা হচ্ছে। যাত্রীদের নিরাপদ ঈদ-যাত্রার জন্য প্রশাসন, পুলিশ, নৌ-পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে সচেতন করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, লঞ্চ চলাচলের পথে পণ্যবাহী নৌযান বাধা সৃষ্টি না করে সেজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছে।
পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে রাজধানী ছাড়ছেন কর্মজীবী মানুষ। নগরবাসীর স্রোত গিয়ে থামছে টার্মিনালগুলোতে। এরমধ্যে ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি মোটামুটি মানা হলেও বাসে তার অর্ধেক দেখা গেছে। আর লঞ্চগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি নেই বললেই চলে। ফলে লঞ্চ ও বাসের যাত্রীরা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে ঘরমুখো হচ্ছেন। নগরীর টার্মিনালগুলো ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। সকালে কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, নির্ধারিত সময়ে বেশ কয়েকটি ট্রেন ছেড়ে গেছে। প্রতিটি ট্রেনই অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে গন্তব্যে ছুটছে। স্টেশনের প্রবেশপথেও যাত্রীদের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার লাগানো হচ্ছে, মাপা হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা। আন্তনগরের কোনও ট্রেনেই টিকিট ছাড়া যাত্রী উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে বেসরকারিভাবে চলাচলরত কমিউটার ট্রেনগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি আসনেরও টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। এই ট্রেনগুলো সব স্টেশনে থামায় অতিরিক্ত যাত্রী জোর করে ট্রেনে উঠে যান বলে জানিয়েছে রেলওয়ে।
এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, লোকাল ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি না মানার আশঙ্কা আমাদেরও ছিল। কারণ লোকাল ট্রেন প্রতিটি স্টেশনে থামে। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ যাত্রী ওঠে। এটা বন্ধ করা গেলে লোকাল ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি মানানো যাবে। তবে আন্তনগরের কোনও ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার সুযোগ নেই। ট্রেনগুলো অর্ধেক আসান ফাঁকা রেখেই পরিচালনা করা হচ্ছে।
সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, বড় বড় কোম্পানির এসি বাসগুলোতে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে যাত্রী পরিবহন করা হলেও অধিকাংশ বাসই তা মানছে না। সব আসনে যাত্রী নিয়ে তিনগুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গাবতলী টার্মিনালে দেখা গেছে, সেলফি পরিবহনের একটি বাসে পাশাপাশি যাত্রী তোলা হচ্ছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি পরিবহনকে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যেতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যে কোম্পানি বা মালিক আইন লঙ্ঘন করে পরিবহন পরিচালনা করবে তার সদস্যপদ বাতিল হবে। আমরা এরইমধ্যে সব মালিক ও কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি তারা যেন স্বাস্থ্যবিধিসহ সরকারি নিয়ম মেনে পরিবহন পরিচালনা করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অনুরোধ করেছি তারা যেন সড়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।
অপরদিকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। স্বাস্থ্যবিধির কোনও তোয়াক্কা নেই এই টার্মিনালে। প্রতিটি পন্টুনেই অতিরিক্ত যাত্রী। লঞ্চগুলোর ডেকের পাশাপাশি সিঁড়ি, বিভিন্ন কেবিনের সামনের গলি ও ছাদেও যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো যাত্রা করলেও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
হাতিয়াগামী তাসরিফ-১ লঞ্চের যাত্রী মামুনুর রশিদ বলেন, লঞ্চ থেকে ফোনে জানানো হয়েছে সন্ধ্যা ৬টার পরিবর্তে সকাল আটটায় লঞ্চ ছেড়ে দিবে। এরমধ্যে যাত্রী এসে লঞ্চ ভরে গেছে। এরপরও লঞ্চ ছাড়েনি। ৮টার পরিবর্তে সেই লঞ্চ ছেড়েছে সকাল ১০টায়। কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। ডেকে হাঁটা যায় না। ছাদেও যাত্রী রয়েছে। বৃষ্টি হলে তাদের ভিজতে হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, স্বাস্থ্যবিধির নিশ্চয়তায় যাত্রীদের বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। টার্মিনালে পন্টুনের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। তারা যাত্রীদের বারবার মাস্ক পরার কথা বলছেন। এছাড়া যাত্রীদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নৌ-পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত আছেন।