মোস্টবেট বাংলাদেশের সেরা বুকমেকার। স্পোর্টস বেটিং, অনলাইন ক্যাসিনো সকলের জন্য সীমাবদ্ধতা ছাড়াই উপলব্ধ, এবং একটি ব্যাঙ্ক কার্ডে Mostbet withdrawal সম্ভব!
Türkiye'nin en iyi bahis şirketi Mostbet'tir: https://mostbet.info.tr/

বাংলাদেশ, মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নানা রঙের সেই দিনগুলি! স্মৃতিতে চরকানাই বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ব্যাচ’৯৮


প্রকাশের সময় :১৫ জুন, ২০২৩ ৬:০০ : পূর্বাহ্ণ

এম.এইচ মুরাদ:

মানুষের জীবনে সবচেয়ে আবেগময় স্মৃতিময় আনন্দময় কোন অধ্যায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে হাতেগোনা ব্যাতিক্রম ছাড়া প্রায় প্রত্যেকেই যে সময়টির কথা উল্লেখ করবেন সেটা নিঃসন্দেহে স্কুল জীবন। স্কুল জীবন অধিকাংশ মানুষের জীবনেই শ্রেষ্ঠ সময়।জীবনের মধুরতম সময়।স্কুল জীবনকে জীবনের বসন্ত বেলাও বলা যায়।জীবন তার সমস্ত নির্মল রং,রূপ,সৌন্দর্য নিয়ে পরিস্ফুট হয় এসময়।বলা যায় স্কুল হলো পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ। যেখানে নেই কোন পাপ,নেই কোন অনাচার, নেই কোন অনিয়ম। প্রত্যেকটি ছাত্র -ছাত্রীই একেকজন ফেরেশতা। এরা জানে না মিথ্যা,জানে না ছলনা,জানে না প্রবঞ্চনা, জানে না নোংরা পৃথিবীর কদর্যতা।

স্কুলকে আমি কখনো স্কুল বলি না। আমি সবসময় স্কুলকে বলে থাকি সাজানো বাগান, ফুলের বাগান। প্রত্যেকটি ছাত্র, ছাত্রী একেকটি ফুল। কারণ এরা প্রত্যেকেই ফুলের মতোই নিষ্পাপ, ফুলের মতোই পবিত্র,ফুলের মতোই রঙিন, ফুলের মতোই সুন্দর। ফুল তার সুবাস দিয়ে মানুষকে বিমোহিত করে,পক্ষান্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের সম্বল তাদের সারল্য,সততা,সদাচার।ছাত্র ছাত্রীরা যেমন এ কাননের ফুল,শিক্ষক-শিক্ষিকারা তেমনি এ ফুলের মালি। যথার্থ পরিচর্যা দিয়ে ফুলগুলোকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হতে সাহায্য করেন তাঁরা।তাঁদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার বদান্যন্যতায় কলি থেকে সৃষ্টি হয় পরিণত পূর্ণাঙ্গ ফুল। অবশ্য বর্তমানে ডিজিটাল যুগে হয়তোবা অল্প কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী আমাদের সময়ের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম বা এডভান্স পরিলক্ষিত হতেও পারে কিন্তু তা কদাচিৎ বা উল্লেখযোগ্য হারে নয়।

ছাত্রজীবনে মানুষ বিচরণ করে ফুলের বনে,স্বর্গের পরম ছায়াতলে।কিন্তু মজার বিষয় হলে তিতা না খেলে যেমন মিষ্টির প্রকৃত স্বাদ বলা যায় না তেমনি কঠিন বাস্তব জীবনে প্রবেশ না বোঝা যায় না স্কুল জীবনের মাহাত্ম্য। তাই ছাত্রাবস্থায় কেউই স্কুলের মাহাত্ম্য বুঝতে পারে না।স্কুলের মাহাত্ম্য বুঝে মানুষ কর্মজীবনে প্রবেশের পর। স্বার্থের পৃথিবীতে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার পর মানুষ অনুভব করে স্কুল জীবনের সৌন্দর্য। বাজারের ব্যাগ হাতে নেয়ার পর মানুষ বুঝতে পারে স্কুল ব্যাগ কতোটা হালকা ছিল। তাইতো কষ্টকর ক্লান্তিময় দীর্ঘ দিনের অবসরে মানুষ স্মরণ করে তার সুন্দর সোনালি অতীত।মনে করে তার ফেলে আসা স্কুলের সেই স্বপ্নময় বর্ণালি দিনগুলো।

স্কুল জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গেলে কমবেশি সবারই বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস ঝরে। আহ্ এখনো মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে মনে হয় আমরা এখনো স্কুলেই পড়ছি। সকালে মক্তব থেকে আসার পর সকালের নাস্তা সেরে স্কুলে যাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি এখনো মিস করি। কারো সময়ের অবমূল্যায়নের জন্য, কারো ফেলে আসা সে সময়ের জন্য,কারো বন্ধু -বান্ধবের জন্য,কারো শিক্ষক -শিক্ষিকাদের জন্য।স্কুল জীবনের কথা উঠলে কেউ করেন আক্ষেপ,কেউ করেন অনুশোচনা কেউ বা মনের অজান্তে ভেসে যায় নষ্টালজিয়ায়। আর সবার মতো আমিও স্কুল জীবনের কথা মনে করে প্রায় হয়ে পড়ি স্মৃতিকাতর। ব্যস্ত বিষন্ন দিনের শেষে কখনো স্কুল জীবনের কথা মনে পড়লে হৃদয়ে ওঠে হাহাকার। স্মৃতির জানালা একটু খুলে দিতেই হু হু করে ঢোকে বিগত সেই সুখ ভাবনা।

স্কুল জীবন বলতে আমরা বেশিরভাগই মাধ্যমিক স্তরকেই বুঝি। মাধ্যমিকে আমাদের বোধশক্তি কিছুটা পরিণত হয়। রহস্যময় পৃথিবীর দ্বার একটু একটু উন্মোচন হতে থাকে আমাদের সামনে।মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই মূলত পৃথিবীর সাথে আমাদের সত্যিকার পরিচয় পর্ব শুরু। তাই এসময়টা আমাদের কাছে খুবই তাৎপর্যময়। আমাদের চোখে মুখে তখন অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার তীব্র বাসনা। শিক্ষক -শিক্ষিকা,সহপাঠী বন্ধু -বান্ধব আর পুঁথির মধ্যে লুকায়িত জ্ঞানের সহায়তায় আমরা আবিষ্কার করি পৃথিবীর নিত্য নতুন সব তথ্য।

আমার সত্যিকার পৃথিবীর সাথে পরিচয়পর্ব শুরু হয় প্রাথমিক পেরিয়ে মাধ্যমিকে অর্থাৎ চরকানাই বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। আমার মাধ্যমিক শিক্ষা এ স্কুলেই। এই মাধ্যমিক স্কুলটি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই গ্রামের সফর আলী মুন্সির হাটে অবস্থিত। ১৯৫০ সালে স্থাপিত প্রাচীনতম এ স্কুলেই আমি কাটিয়েছি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। এই স্কুল আমাকে দিয়েছে শিক্ষা, আমাকে দিয়েছে দীক্ষা। আমাকে দিয়েছে চলার পথের পাথেয়, চড়িয়েছে রঙিন ঘোড়ার রথেও।দেখিয়েছে পৃথিবীর রূপ সৌন্দর্য, দিয়েছে সন্ধান অজানা গন্তব্য। এই স্কুলেই আমি পেয়েছি বসন্তের স্নিগ্ধ সমীর, দেখেছি রংধনুর সব আবীর। পেয়েছি স্বর্গের অনাবিল স্পর্শ, দেখেছি সুদৃশ্য নির্মল কাননের দৃশ্য।

যেদিন প্রথম এই স্কুলে এসেছিলাম সেদিন ঘুর্ণাক্ষরেও হয়তো ভাবিনি এ স্কুল আমার পুরো সত্ত্বার সাথে সারাজীবন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকবে। এমনকি যখন পড়েছি তখনও বুঝিনি আমার জীবনে এ সময়, এ স্কুলের গুরুত্ব। আর দশটা ছেলের মতোই বাবার হাত ধরেই আমার প্রথম এ স্কুলে আসা। বাবার কানি আঙ্গুল ধরে যেদিন প্রথম পা রেখেছিলাম এ স্কুলের চৌকাঠে সেদিন আমি ছিলাম অবুঝ, ছিলাম নির্লিপ্ত নির্বিকার। তাই সেদিনের সব স্মৃতি সযতনে কুঁড়াতে পারিনি। তারপরও যতোটুকু কুঁড়াতে পেরেছি তাই এ লেখায় চেষ্টা করব তুলে আনতে।

আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে শীতের কোন এক সকাল বেলায় স্কুলের ইউনিফর্ম বিহীন প্রিয় বাবার হাত ধরে হেঁটে চলছিলাম জীবনের এক নতুন অধ্যায় রচনায় (১৯৯৩ ইং)। সদ্য প্রাথমিকের চেনা পরিবেশ ছেড়ে যাওয়ার ব্যাথা ও নতুন পরিবেশের জড়তা শীতের প্রকৃতির মতোই আমাকে করে রেখেছিল আড়ষ্ট। আমি ছিলাম দ্বিধান্বিত, ছিলাম শংকিত। আমার নতুন বরণ আর নতুনের আমাকে বরন সুখকর হবে তো? মনের এই দ্বিধাচলের মধ্যেই প্রবেশ করলাম স্কুলের নিচ তলার মূল গেটের প্রথম দিকে ষষ্ঠ শ্রেণির কক্ষে। তখন প্রথমে ভর্তি হলে ‘ক’ শাখায় স্থান পাওয়া যেত। তাই প্রথম দিকে ভর্তি হওয়াতে আমিও ‘ক’ শাখায় স্থান পেলাম।

স্কুলের প্রথম দিনে ভয়, কৌতুহল, জড়তা, আশা, আশংকা, ভাবনা, দুর্ভাবনা সব যেন একসাথে ভর করেছিল আমার ওপর। আমি ছিলাম পুরোপুরি নার্ভাস। আশ্চর্যের বিষয়, শ্রেণীকক্ষে প্রবেশের সাথে সাথেই কেমন জানি হালকা বোধ করলাম। সব নেতিবাচক ভাবনা আস্তে আস্তে কেটে যেতে লাগল।মেঘ ভেদে সূর্য উঁকি দেয়ার মতো আমার চেহারা ক্রমশ উজ্জ্বল হতে লাগল।সবাই সমবয়সী, সবাই বন্ধুভাবাপন,সবাই আমার মতো দেখে অনেকটা নির্ভার বোধ করলাম। আমার পাশে খুব সম্ভবত আমাদের প্রয়াত বন্ধু ইলিয়াস, তারেক, শ্রীমন ও মহিউদ্দিন বসেছিল। কারণ আমরা তখন একই বেঞ্চে পাঁচজন বসতাম। তারা ছিল দারুণ বন্ধুবৎসল। অবশ্য ইলিয়াস, মহিউদ্দিন ছিলো আমার প্রাথমিকের বন্ধু। কিন্তু অন্য দুজনকে প্রথম দেখে বা আলাপ করে মনেই হয়নি এটি তাদের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। বরং মনে হলো তারা আমার জন্ম জন্মান্তরের পরিচিত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা খুব ভালো বন্ধুতে পরিণত হলাম এবং তা শ্রেণীশিক্ষক প্রবেশের পূর্বেই।

ছবি: চরকানাই বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়

কিছুক্ষণ পর শ্যাম বর্ণের প্রমাণ সাইজের মধ্যবয়সী এক লোক ক্লাসে প্রবেশ করলেন।দেখতে মনে হল নিপাট ভদ্রলোক।লোকটির দেখতে অনেকটা আমার আমার এলাকার নুর আক্তার চাচার মতো। স্বভাবেও চাচার মতো-শান্ত সৌম্য প্রকৃতির।ইনি আমাদের শ্রেণী শিক্ষক। নাম ছিলো জীবনময় বড়ুয়া স্যার। তিনি বাংলার শিক্ষক ছিলেন। তিনি শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করে প্রথমে রোল কল করলেন। তারপর একে একে সবার সাথে পরিচিত হলেন।কিছু মজাও করলেন। শ্রেণী শিক্ষকের সাথে পরিচিত হওয়ার পর, তাঁর আচার ব্যবহার দেখে আমার মনের মধ্যে থাকা অবশিষ্ট ভয় দূর হয়ে গেল।আমি ক্লাসে অনেকটা ধাতস্থ হয়ে গেলাম।

এরপর একে একে আরো তিন ঘন্টায় বা ক্লাসে তিনজন শিক্ষক এলেন। প্রথমদিন কেউই বিশেষ কিছু পড়ালেন না। সবাই পরিচয় পর্ব শেষে কিছুটা খোশগল্প করে ক্লাসের ইতি টানলেন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আরো নতুন কিছু বন্ধুর সাথে পরিচয় হলো। ফারুক, তালেব, মালেক, তারেক, রিটন, লিটন, গিয়াস, শুক্কুর, আলী আজম, ইমাম, ফোরকান সহ আরো অনেকের সাথেই প্রথম পরিচয় হলো। সবাই ছিল খুবই আন্তরিক ও বন্ধুভাবাপন্ন। একদিনের পরিচয়েই আমরা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। মধ্যাহ্ন বিরতির সময় আমরা অনেক গল্প করলাম। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হলো।আরো কিছু নতুন বন্ধুর সাথে পরিচয় হলো অদম সাইফুল, চার্চিল, হাবিব, নজরুল, ইমাম হোসেন, মহিউদ্দিন, শুক্কুর, কাউছার, সাজু বড়ুয়া, মন্জুর, তারেক, করিম, সন্তোষ, রিগ্যান, যদু, রফিক, তাহের, সেলিম, দেলোয়ার, বশর, দিলীপ, বকতেয়ার, নয়ন বড়ুয়া, সমীরন জলদাশ, কৌটিল, মাবুদ, জোনাইদ বোগদাদী, আবদুল, ফরিদ, আনিস, তৌহিদ, মালেক, রফিক, মুছা, ছোটন, বিনোদ সহ আরো অনেকে……

সারাদিনই অনেক নতুন বন্ধুর সাথে পরিচয় হলো। ক্লাসের ফাঁকে তাদের সাথে অনেক আলাপ হলো। তাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। তাদেরও আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানালাম। তুই তোকারি ঠাট্টা ইয়ার্কিতে আমাদের সম্পর্ক খুব জমে উঠলো। নতুন স্কুল আমার কাছে আর নতুন রইল না। একদিনেই সব জড়তা কেটে গেল। বিভিন্ন পরিবেশ থেকে আাসা আমরা একেকজন কীভাবে এতো অল্প সময়ে একেকজনের এতো আপন হয়ে উঠলাম তা আজো আমার কাছে অবিশ্বাস্য ও আশ্চর্যজনক! যেটি আমি পরবর্তীতে কলেজ জীবন বা ভার্সিটি জীবনে তেমনটা পাইনি। স্কুলের ক্লাসমেট ছাত্রীদের প্রতি আলাদা একটা টান থাকলেও, আমি স্কুলে থাকা অবস্থায় কোন মেয়ের সাথে সরাসরি কথা বলতে খুব লজ্জা পেতাম। কেয়া, কুমকুম, জোবাইদা, হালিমা, নিলুফা, প্রয়াত বেবী, লুতফা, আফরোজা, শিল্পী নাথ, খালেদা, রোকসানা, রেহেনা সহ আাস্তে আমাদের ক্লাসের সব মেয়েদের নাম জানতে শুরু করলাম। যা পরে উচ্চ ক্লাসে যাওয়ার পর একজনের নামের সাথে আরেকজনের নাম বলে কত খুনসুটি করতাম তার ইয়ত্তা নেই। অথচ সম্পর্ক গুলো ছিলো নিস্পাপ।

দিন যতোই গড়াতে থাকলো আমাদের সম্পর্ক ততোই হৃদ্যতাপূর্ণ হতে লাগল। স্কুল ক্রমেই আমাদের ভালো লাগার একটি জায়গায় পরিণত হতে লাগল। বন্ধু বান্ধবদের সাথে সাথে স্যারদের সাথেও রসায়ন ধীরে ধীরে জমতে লাগল। একেক ধরনের আচরণের জন্য একেক স্যার আমাদের কাছে একেক নামে পরিচিতি পেতে লাগল। বিশ্বনাথ স্যার, স্টীল বডি স্যার, আমজাদ স্যার, নাসির স্যার, পন্ডিত স্যার, সন্তোষ স্যার, এসিস্ট্যান্ট হেড মাষ্টার অরুন স্যার, নির্মল স্যার, রতন স্যার, সন্জুরানী মেডাম, নাসরিন মেডাম, জীবনময় স্যার, হুজুর স্যার..। আমাদের আলাপচারিতায় তাঁরা একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে থাকতেন। মজার ব্যাপার হলো স্কুল ত্যাগের এতো বছর পরেও তাঁরা এখনো তাঁদের সেই বিশেষ আদল, আচরণ বা বৈশিষ্ট্যের জন্য আলোচনার টেবিলে সমান উপাদেয়।

আমাদের প্রত্যেকটি শিক্ষকই ছিলেন ইউনিক।কারো কথা বলার ধরন, কারো পড়ানোর ধরন, কারো হাঁটার ধরন, কারো হাসির ধরন, কারো পোশাক-আশাকের ধরন ছিল সম্পূর্ণ অনন্য ও ব্যাতিক্রম।এসব অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য ছাত্রসমাজে এঁদের কয়েকজনের ছিল ভিন্ন ভিন্ন নাম। যেমন স্টীল বডি, বাকের ভাই ইত্যাদি। তবে এসব নাম মোটেও তাঁদের অবজ্ঞা বা উপহাসের জন্য নয় বরং এসব নাম ছিল তাঁদের প্রতি ছাত্রদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ইংরেজিতে বললে এ নামগুলি ছিল তাঁদের পেট নেইম।

আমাদের স্কুলের গল্প করতে গেলে,শিক্ষকদের কথা বলতে গেলে, অনন্যতার কথা বলতে গেলে যাঁর কথা আলাদা করে বলতে হয় তিনি আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধান শিক্ষক নুরুল আলম এর কথা। তিনি ছিলেন অনন্য অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। তিনি ছিলেন সত্যিকারার্থেই একজন অমনিবাস। একজন আদর্শ প্রধান শিক্ষকের সব গুণাবলি তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল, হয়তো একটু বেশিও ছিল।তিনি ছিলেন একাধারে একজন দক্ষ প্রশাসক,একজন আদর্শ শিক্ষক,একজন আদর্শ মানুষ, একজন সুবক্তা, একজন প্রকৃত নেতা। তবে ছাত্রসমাজে তিনি তাঁর দারুণ রসবোধের জন্য নন্দিত।বিশেষ করে তাঁর উচ্চ স্বরে তুড়ি মেরে কথা বলার স্টাইল ছিল ইউনিক। গল্পচ্ছলে পড়ানোর কথা বললে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

প্রধান শিক্ষকের পাশাপাশি আরো কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন যারা তাঁদের জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে শ্রীযুক্ত বিধু ভুষন ও শ্রীযুক্ত বিশ্বনাথ চৌধুরী কথা একটু আলাদা করেই বলতে চাই। ইংরেজি ও গণিতে এ দু’জনের পাণ্ডিত্য ছিল তুখোড়। গণিতের মতো কঠিন একটি বিষয়কে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাবে উপস্থাপনের একটি সহজাত ক্ষমতা ছিল বিশ্বনাথ স্যারের। বিশ্বনাথ স্যার স্কুলের নিচ তলায় সিঁড়ির এক কামড়ার একটা রুমে থাকতো। সকালে যখন আমরা স্কুলে যেতাম তখন ওনার শুটকি দিয়ে তরকারি রান্না করার সুগন্ধিতে জিবে জল চলে আসতো। এছাড়াও সন্জুরানী মেডাম বাংলা ২য় পত্র ক্লাস তাঁর সহজবোধ্য প্রাঞ্জল উপস্থাপনার কারণে ছিল অনন্য। এখনো মনে পড়ে এক এক শিক্ষকের এক এক রকম শাস্তির কথা। আমজাদ স্যার হাতের উল্টোদিকে ডাস্টার দিয়ে মারতো, সন্তোষ স্যার হাতের কনুই এর নিচ থেকে পুরা হাতে বেত দিয়ে মারতো, বিশ্বনাথ স্যার পিঠে, জীবন স্যার টেবিলের নিচে কয়েকজনকে একসাথে মাথা ঢুকায় তারপর টেবিলে ওঠে চারদিকে ঘুরে-ঘুরে মারতো। হেড স্যার প্রথম বেঞ্চ থেকে সবাইকে বেত দিয়ে মারা শুরু করতো একদম শেষ বেঞ্চ পর্যন্ত, এতে কারো গায়ে বেতের বারি বেশি পরতো আবার কারো গায়ে কম পরতো।

ছাত্র-শিক্ষকদের অনেক মজাদার আকর্ষণীয় গল্পের মাঝে কিছু পার্শ্বচরিত্রও ছিল।এসব পার্শ্বচরিত্রগুলোও কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। তেমনি একটি জনপ্রিয় পার্শ্বচরিত্র ছিলেন নির্মল বড়ুয়া। আমাদের সময় স্কুলের হেড ক্লার্ক ছিলেন এই নির্মল বড়ুয়া।এই নির্মল বড়ুয়া ছিলেন নিরীহ গোবেচারা টাইপের লোক। হেড স্যারের ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকতেন। হেড স্যারের সামনে গেলে তিনি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যেতেন। হেড স্যার আবার ব্যাপারটা খুব উপভোগ করতেন। মনে হতো মাঝে মাঝে শুধু মজা নেয়ার জন্য তিনি নির্মল স্যারকে ডেকে জেরা করতেন। আড়ালে আবডালে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটি আমরাও অনেকবার উপভোগ করেছি।

এছাড়াও সেসময় বিদ্যালয়ের দপ্তরী শরীফ চাচা (বর্তমান দপ্তরী সাইফুলের বাবা) আর ইউসুফ চাচার কথাও মনে পড়ছে আজ খুব। একেবারে নিরীহ সাধারণ মানুষের উদাহরণ হয়েই থাকবেন তারা দু’জন। আর একজন আয়া ছিলো যিনি প্রত্যেকদিন সাদা কাপড় পড়ে কোলাগাঁও থেকে ছাত্রীদের লাইন ধরে নিয়ে আসতো। টিফিন ছুটির সময় মেয়েরা টাকা দিলে সিংগাড়া চমুছা আনতো মাসি মেয়েদের জন্য নুর মোহাম্মদ সওদাগর বা মুসলিম সওদাগরের চায়ের দোকান থেকে।

স্কুলের ভেতরের পাশাপাশি বাইরের আনুষাঙ্গিক কিছু ঘটনা,ব্যাক্তি ও বস্তুও বেশ স্মরণীয়। স্কুলের সামনে বসা ঝালমুড়িওয়ালা,আচারওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা এনারাও ছিলেন আমাদের খুব পরিচিত। তাদের সাথেও ছিল ভালো আচরন ছিলো আমাদের। আটআনা দামের নারিকেল কলা আইসক্রিম বা আটআনার ৬টা জলপাই আচার বা চারআনার লটারিতে ১০টি জলপাই আচার পাওয়ার আনন্দ এখনো ভুলতে পারিনি। টিফিন ব্রেকের সময় দলবেঁধে ভিডিও গেইমসের দোকানে হুমড়ি খেয়ে পড়ার দৃশ্য এখনো যেন চোখের সামনে জ্বাজ্জল্যমান। প্রয়াত বন্ধু ইলিয়াসের কন্ঠে এন্ডুকিশোর, মনির খান, শুভ্র দেবের গান আর বন্ধু সাজু বড়ুয়ার টেবিলে বাজানো ঢোল এর আওয়াজ এখনো কানে বাজছে মনে হয়। সাথে আমাদের সব বন্ধুদের বেসুরা গলায় তাদের সাথে ঠোঁট মিলানোটা ছিলো দেখার মতো। আর এজন্য কতোবার শ্রেনী শিক্ষকের মার খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠলাম তখন আমাদের ক্লাস রুম ছিলো দুতলার একদম কর্নারের দিকে। আর এই রুমের জানালার পাশে ছিলো নারকেল গাছ। কতোবার এই নারকেল গাছ থেকে ডাব এবং নারকেল চুরি করে ক্লাসের বন্ধুরা খেয়েছে তার হিসেব নেই। এর প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলাম আমরা কয়েকজন। অবশ্য তাদের খাওয়ার পর আমাদেরও শেয়ার করতো যেনো আমরা এই বিষয়ে কারো কাছে মুখ না খুলি। স্কুল মাঠে চলতো কতো ধরণের খেলা। দীর্ঘ লাফ, উচ্চ লাফ, চেয়ার খেলা, দৌড় প্রতিযোগিতা, গোল্লাছুট, হা-ডুডু, ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি।

যখন নবম শ্রেণিতে উঠলাম তখন আমরা তিনভাগে ভাগ হয়ে গেলাম। অর্থাৎ কেউ বিজ্ঞান বিভাগে, কেউ ব্যবসায় আবার কেউবা মানবিকে। কিন্তু আমাদের জেনারেল সাবজেক্ট গুলো একসাথে হতো। শুধুমাত্র বিভাগ ভিত্তিক বিষয়গুলো আলাদাভাবে হতো। আমি নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ নিলাম। তখন বিজ্ঞান বিভাগে আমরা ২৭জন ছিলাম। ছেলে উনিশজন এবং মেয়ে আটজন। বিজ্ঞান বিভাগের বেশির ভাগ ক্লাস দুতলার সিঁড়ির পাশের রুম অর্থাৎ ল্যাবরেটরিতে হতো। আমরা যখন সবার থেকে আলাদা হয়ে ল্যাবরেটরিতে যেতাম তখন মনে একটা খারাপ লাগা কাজ করতো। কারণ এতোজন বন্ধুদের ফেলে আমরা মাত্র কয়েকজন বিজ্ঞান ক্লাসের জন্য যেতাম। আবার বিজ্ঞান ক্লাসে গেলে নিজেকে বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী মনে হতো। প্রিয় বিশ্বনাথ স্যার খুবই মুড নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করে আবার নতুন করে রোল কল করতো। ছেলেরা পশ্চিমের লাগোয়া বড় টেবিলগুলোতে এবং মেয়েরা পূর্বের টেবিলগুলোতে বসতো। তারপর শুরু হতো রসায়নের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার জটিল আলোচনা। অনেক সময় স্যার কি বলতো তা আয়ত্ত করতে না পেরে তা মাথার উপর দিয়ে উড়িয়ে দিতাম। আমাদের গ্রুপ সাবজেক্ট গুলো প্রায় সময় ৬ষ্ঠ বা ৭ম ঘন্টায় হতো। তখন আমরা ক্লান্ত থাকতাম। কারণ দুপুরের ছুটি বা টিফিন ছুটিতে আমরা প্রচুর দৌড়াদৌড়ি বা খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতাম। পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, ব্যবহারিক এগুলো নিয়ে গ্রুপ ক্লাস গুলো হতো। জীব বিজ্ঞান ব্যবহারিকে অপারেশন করতে হতো বা কাটতে হতো ব্যাঙ, আরশোলা, কেঁচো ইত্যাদি। প্রিয় আমজাদ স্যার জীব বিজ্ঞান ক্লাস এবং ব্যবহারিক করাতো আমাদের। আমজাদ স্যারকে নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে আমাদের। বিষয়টি যদিও বলার মতো না তবুও আমি অন্য একসময় বলার চেষ্টা করবো।

দেখতে দেখতে কখন যে এই স্কুলে পাঁচটি বছর কাটিয়ে দিলাম তা বুঝতেই পারলাম না। মনে হল চোখের পলকেই কেটে গেল পাঁচটি বছর। হঠাৎ একদিন বেজে উঠলো বিদায়ের ঘন্টা। প্রতিদিন যে ঘন্টা শুনলে আনন্দিত হতাম সেইদিন সেই ঘন্টা শোনার পর হৃদয়ের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। যে ভয় যে শংকা নিয়ে প্রথমদিন এ স্কুলে এসেছিলাম বিদায়লগ্নে আবার তা নতুন করে অনুভব করলাম। তবে এবারের ভয় ছেড়ে যাওয়ার ভয়,এবারের ভয় বিচ্ছেদের ভয়,এবারের শংকা স্বজন হারানোর শংকা। আর এভাবেই একদিন ঠিকই বিদায় নিলাম এই প্রাণের বিদ্যাপিঠ থেকে। মূহুর্তেই হয়ে গেলাম প্রাক্তন। পেছনে রয়ে গেলো হাজারো সুখের স্মৃতি।

একটি একটি করে যদি স্কুল জীবনের স্মৃতির কথা বলি তবে তা বলে শেষ করা যাবে না। আসলে স্কুল জীবনের স্মৃতি বলে শেষ করবার নয়ও। আজকের জীবনের এ পর্যায়ে যখন সেসব দিনের কথা মনে পড়ে তখন কেবলি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। এখন সহপাঠীরা যে যার যার কাজে ব্যস্ত, জীবিকার সন্ধানে কেউবা থাকেন ইট-পাথরের শহরে আবার কেউ গ্রামেই তৈরি করে নিয়েছে নিজের কর্মক্ষেত্র। কেউবা জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন সুদূর প্রবাসে। এরই মধ্যে অনেক প্রাণপ্রিয় শিক্ষক, সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়র স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী চেনা মূখ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে তার প্রকৃত হিসাব আমার কাছে নেই। আমি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করছি। অনেক শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব জটিল অসুস্থতায় ভুগছেন। মহান আল্লাহর দরবারে তাদের রোগমুক্তি ও শান্তি কামনা করছি। আজকে আর বেশি কিছু লিখতে পারলাম না কারণ সেই সোনালী অতীতের দিনগুলোর কথা মনে পড়তে অগোচরে ভিজে গেছে চোখের পাপড়ি। মনে পড়ছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানটি , “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়, রইলো না, রইলো না আর, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি”।

চলবে…

ট্যাগ :