স্টাফ রিপোর্টার:
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর নানা আলোচনা আর টানাপড়েনের মধ্যে জাতীয় পার্টির প্রথম কাউন্সিল বসছে, যেখানে এরশাদপত্নী রওশনের জন্য তৈরি হবে নতুন পদ। বর্তমানে ‘সিনিয়র কো চেয়ারম্যান’ পদে থাকা রওশনের নতুন পদের নাম হবে ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’। চেয়ারম্যান পদে এরশাদের ভাই জি এম কাদেরই বহাল থাকছেন। জাতীয় পার্টির নবম কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের আগের দিন গতকাল শুক্রবার দলের প্রেসিডিয়ামের বৈঠক শেষে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান।
তিনি বলেন, এবারের মূল পরিবর্তন হচ্ছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদ ‘চিফ প্যাট্রন’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। দলে উনার সম্মান থাকবে সর্বোচ্চ। মিটিং বা সাধারণ সভা- সবখানেই উনার এই সর্বোচ্চ সম্মানটা থাকবে। সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান আর চিফ প্যাট্রন পদের মধ্যে মর্যাদার ভারসাম্য কীভাবে হবে? রাঙ্গাঁ বলেন, দলের সর্বক্ষেত্রে রওশন এরশাদের অবস্থান দলের চেয়ারম্যানের ঊর্ধ্বে থাকবে, এটা চেয়ারম্যান বলেছেন।
গত ২০১৬ সালে মার্চে পার্টির অষ্টম কাউন্সিলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কো চেয়ারম্যানের পদ তৈরি করে তাতে ভাই জি এম কাদেরকে আসীন করেন। স্ত্রী রওশন এরশাদ তাতে ক্ষিপ্ত হলে পরে তার জন্য এরশাদ তৈরি করেন সিনিয়র কো চেয়ারম্যানের পদ। রওশন আর জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব তখন থেকেই।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চলতি বছরের ৫ মে তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। পরে ১৪ জুলাই ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এরশাদ। এর চার দিনের মাথায় বনানীতে পার্টি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের নাম ঘোষণা করেন।
তার পাল্টায় রওশনপন্থিরা সংবাদ সম্মেলন করে রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে শৃক্সখলাভঙ্গের অভিযোগ আনার কথা বলে। পরে দুই পক্ষের সমঝোতা হলে ৮ সেপ্টেম্বর আরেক সংবাদ সম্মেলনে রাঙ্গাঁ জানান, জিএম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবেন। আর রওশন এরশাদ হবেন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা।
সেই সমঝোতার পর রওশনকে সংসদ অধিবেশেন দেখা গেলেও দলের কার্যক্রম থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। এই দূরত্ব ঘোচাতেই দলের নবম কাউন্সিলে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে তাকে নতুন পদে বসানোর পরিকল্পনা হয়েছে বলে আভাস দিলেন জাতীয় পার্টির এক জ্যেষ্ঠ নেতা। রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত ওই নেতা বলেন, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ নিতে রওশন এরশাদেরও সায় আছে। আর দলের মহাসচিব রাঙ্গাঁ ব্রিফিংয়ে তার আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলেন, চেয়ারম্যানের কাছে দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকবে। যত মিটিং হবে, তা তিনি প্রিসাইড করবেন। তবে যেহেতু হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের সহধর্মিনী এখনও জীবিত, তাই তিনি যত দিন জীবিত রয়েছেন, তিনি চিফ প্যাট্রন হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০-ক উপধারায় দলের চেয়ারম্যানকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। সেই ধারা রদ বা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা এর আগে জি এম কাদের বললেও রাঙ্গাঁ জানালেন, নবম কাউন্সিলে তা হচ্ছে না। তিনি বলেন, গঠনতন্ত্রের ২০-ক এর উপধারা প্রয়োগের আগে চেয়ারম্যান দলের কো চেয়ারম্যান ও প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবেন। একক সিদ্ধান্তে দল চলে না। এখন থেকে দলের সিদ্ধান্ত এককভাবে কেউ দেবে না। দলের প্রেসিডিয়াম ও দলের কো চেয়ারম্যান যারা আছেন, সবাই মিলে দলের সিদ্ধান্ত দেবেন। চেয়ারম্যানও এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে চান না।
রওশনের নতুন পদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরও বাড়াবে কি না- এ প্রশ্নে রাঙ্গাঁ বলেন, এটা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। কোনো কন্ট্রাডিকশন হবে না। চিফ প্যাট্রন, চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মিলে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত আনিসুল ইসলাম মাহমুদের পাশাপাশি সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকেও শুক্রবারের প্রেসিডিয়াম সভায় দেখা গেছে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে মহাসচিবের পদ হারানোর পর এই প্রথম তিনি কোনো সভায় যোগ দিলেন।
পার্টির গঠনতন্ত্রে আরও অনেক ধারায় পরিবর্তন আসতে পারে জানিয়ে রাঙ্গাঁ বলেন, প্রেসিডিয়ামের সভায় দলের নেতারা পরিবর্তনের দাবি এনেছেন। পরে পরিবর্তন, সংযোজন, পরিবর্ধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যানকে। জাতীয় পার্টিতে এখন ৪১ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য রয়েছেন। বৈঠকে এই সংখ্যা কমিয়ে আনার পক্ষে মত এসেছে বলে জানান রাঙ্গাঁ। তিনি বলেন, প্রেসিডিয়ামে সদস্য সংখ্যা কমবে না বাড়বে সে সিদ্ধান্ত আজ শনিবার দলের নবম কাউন্সিলের পর নেবে জাতীয় পার্টি। তবে কাউন্সিলে চার-পাঁচ জনকে দলের সিনিয়র কো চেয়ারম্যান ও কো চেয়ারম্যানের পদে আনা হতে পারে।
জাতীয় পার্টির বেশ ক’টি সহযোগী সংগঠন কাউন্সিলে অঙ্গ সংগঠনের স্বীকৃতি পাবে বলেও জানান জাপা মহাসচিব। আজ সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের বাইরে হবে কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। দুপুরে মিলনায়তনের ভেতরে হবে ভোটাভুটি। জাপার কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের মৌখিক ভোটে চেয়ারম্যান, কো চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নেতা নির্বাচন করা হবে। জাপার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, প্রতি তিন বছর পর পর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে।