বিনোদন ডেস্কঃ
এ যেন পৃথিবীর মধ্যে আরও একটি পৃথিবী। বাইরের কোনও নিয়ম সেখানে প্রযোজ্য নয়। যারা সেখানকার বাসিন্দা, সেই প্রাণীরা সাড়ে পঞ্চাশ লক্ষ বছর ধরে বিচ্ছিন্ন ছিল বাইরের জগৎ থেকে। এ রকমই এক বিচিত্র ও বিস্ময়ের জায়গা হল রোমানিয়ার মোভাইল গুহা। রোমানিয়ার কনস্টান্টা কাউন্টির ম্যাঙ্গালিয়া অঞ্চলে এই গুহা আবিষ্কৃত হয় ১৯৮৬ সালে। রোমানিয়া-বুলগেরিয়া সীমান্তে কৃষ্ণসাগরের উপকূল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই এই প্রাকৃতিক বিস্ময় আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান লাস্কু। সে সময় আশির দশকে রোমানিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন। জনমানবহীন ম্যাঙ্গালিয়া প্রান্তরে চলছিল সয়েল টেস্ট। দেখা হচ্ছিল সেখানে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব কি না। তখনই ধরা পড়ে এই রহস্যজনক বিষাক্ত গুহার অস্তিত্ব। অদ্ভুত বাস্তুতন্ত্রের সাক্ষী এই গুহা। এখানে প্রচুর পরিমাণে হাইজ্রোজেন সালফাইড এবং কার্বন ডাই অঙাইড আছে। বদ্ধ হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই এখানে অক্সিজেন কম। ফলে এই গুহার বিষাক্ত পরিবেশে ফোটোসিন্থেসিস (সালোকসংশ্লেষ)-এর বদলে জীবন এগিয়েছে কেমোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
ফোটোসিন্থেসিসের বিপরীত প্রক্রিয়া হল কেমোসিন্থেসিস। ফোটোসিন্থেসিসে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশে মুক্ত হয় অক্সিজেন। কিন্তু কেমোসিন্থেসিসে হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং সামান্য অক্সিজেন অথবা নাইট্রেটের বিক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে সালফার উৎপন্ন হয়। অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতেও এই প্রক্রিয়া হতে পারে। অতল মহাসাগরের গভীরে, অন্ধকার গুহা-সহ পৃথিবীর বহু অংশে এই কেমোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় বাস্তুতন্ত্র আবর্তিত হয়। ঠিক সে ভাবেই হয়েছে মোভাইল গুহাতেও। প্রকৃতির নিয়মে এই গুহায় বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর বাকি অংশের তুলনায় আলাদা। সাধারণত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় অনুপাতের ২১ শতাংশ অঙিজেন। কিন্তু মোভাইল গুহায় অক্সিজেনের উপস্থিতি মাত্র ৭-১০ শতাংশ। কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইডের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ঠিক উল্টো। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ যেখানে ০.০৪ শতাংশ, সেখানে মোভাইল গুহায় কার্বন ডাই অক্সাইড আছে ২ থেকে ৩.৫ শতাংশ।এই গুহায় মিথেনের পরিমাণ ১ থেকে ২ শতাংশ। পাশাপাশি মোভাইল গুহার বাতাস এবং জলে প্রচুর পরিমাণে হাইজ্রোজেন সালফাইড ও অ্যামোনিয়া আছে। রহস্যজনক এই গুহায় বাস করে এমন ৪৮টি প্রজাতির প্রাণীকে শনাক্ত করা গিয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৩টির বাইরের পৃথিবীতে অস্তিত্বই নেই। গুহার জীবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জোঁক, শামুক, মাকড়সা এবং ওয়াটার স্করপিয়ন।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মোভাইল গুহার জীববৈচিত্র্য সাড়ে পঞ্চাশ লক্ষ বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় আজ থেকে সাড়ে পঞ্চাশ লক্ষ বছরের আগে এই গুহায় একসঙ্গে সব প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে। গবেষকদের ধারণা, প্রাকৃতিক নিয়মের শৃঙ্খল অনুযায়ীই আবর্তিত হয়েছে জীবনচক্র। শুধু বাইরের জগতের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল না। সে বেঁচে থেকেছে তার নিজের নিয়মমতো। সূর্যালোক না পাওয়ায় এই গুহার প্রাণীরা অনেকে জন্মান্ধ।
এই গুহামুখ বন্ধই রাখে রোমানিয়া সরকার।
জীববিজ্ঞানীদের ধারণা, এই গুহায় আরও অনেক রহস্য বা বৈচিত্র্য অপেক্ষা করে আছে ভবিষ্যতের জন্য।