এম.এইচ মুরাদঃ
আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয়ের দিন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি মানব নিধন অভিযান শুরু করে। বাঙালির প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণেই করণীয় ও স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ করেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার একটি বাণী তিনি জাতির উদ্দেশে ছড়িয়ে দেন। শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ থেকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, জনযুদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার আস্থাভাজন নেতৃত্ব, মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংবিধানিক বৈধতা প্রদানের মাধ্যমে তৎকালীন দুনিয়ায় সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। এই সমর্থন মুক্তিযুদ্ধকে সফলভাবে বিজয়ের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী মুজিবনগর সরকার সশস্ত্র যুদ্ধকে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার সব প্রশাসনিক, কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতাকে গভীর পর্যবেক্ষণে এনে নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সামরিক শক্তিতে কাবু করার সব আয়োজন সুচারুরূপে পালন করে থাকে। বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন এই সরকারের প্রতি শুরু থেকেই জোরদার হতে থাকে।
পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যা, পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি সব ধরনের বল প্রয়োগের পরও জনগণকে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর সরকারের প্রতি আনুগত্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ফলে ৩ ডিসেম্বরের পর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয় গঠিত মিত্র বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানিবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। ফলে বাঙ্কার, ঘাঁটি, দখলদারিত্ব, ছোট বড় শহর একে একে ছেড়ে দিয়ে ঢাকামুখী হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানিদের দখলে থাকা সব জায়গা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হতে থাকে। এর মানে হচ্ছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রণে ভঙ্গ দিয়ে জীবন বাঁচাতে ঢাকায় দৌড়ে পালায়। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান নিয়াজী ৯৩ হাজার সেনাসদস্য নিয়ে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
২৫ মার্চে শুরু হওয়া আক্রমণ ১৬ ডিসেম্বরে স্তব্ধ হয়ে যায়। ২৬ মার্চ ঘোষিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে বিজয় লাভ করল। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হলো। এর জন্য পূর্ব বাংলার জনগণকে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি তথা জনযুদ্ধ করতে হয়েছিল। এর সবই সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মতো একজন আপসহীন লড়াকু, সংগ্রামী, ত্যাগী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতার হাতে গড়া সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল ও তার প্রতি বিশ্বস্ত অসংখ্য যোগ্য নেতা গড়ে ওঠা এবং বঙ্গবন্ধুর দেয়া কর্মসূচিকে বাস্তবে রূপ দিতে পারার যোগ্যতা রাখার কারণেই। ২৬ শে মার্চের প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পরও কোন ধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই মুক্তিযুদ্ধের মতো এক কঠিন চ্যালেঞ্জ কাঁধে নিতে পেরেছিলেন।
বিজয়ের ৫১ বছর পূর্ণ হয়েছে।৫১তম বিজয় দিবস পালনের ক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা যদি পেছনের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখবো, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। হাজারো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। চার জাতীয় মৌলনীতিসহ অধিকতর উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। একটি অর্থনৈতিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, শিক্ষানীতিসহ নানা ধরনের অগ্রসর রাষ্ট্র ব্যবস্থার আইন, বিধিবিধান, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
পাকিস্তানের মতো একটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দৃঢ়চেতা নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিকল্পনায় কোনো ঘাটতি ছিল না। তিনি একের পর এক জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিতে থাকেন। এইসব উদ্যোগ অব্যাহত রেখেই কেবল পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করার মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনে সফল হওয়া সম্ভব। বঙ্গবন্ধু সেই পথেই হাঁটছিলেন।
সামান্য সময় পেলেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারায় জনগণকে শিক্ষিত করা, আর্থ সামাজিকভাবে দারিদ্রমুক্ত করা তথা শোষণহীন সমতা ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশকে আধুনিক উন্নত সমাজ ব্যবস্থার রাষ্ট্র রূপে বিনির্মিত করতে তার খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়তো না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন একজন নির্লোভ, সৎ, জনদরদী, রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়ক। সুতরাং যে রাষ্ট্রের হাল তিনি ১৯৭২ সালে ধরেছিলেন সেটি এক দেড় দশক তার হাতে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভিত্তিক এবং জনকল্যাণবাদী শোষণহীন সমাজ হিসেবে পরিচালিত হতোই। কিন্তু সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাকে এবং তার বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীদের ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র নির্মাণের পথচলাকে উল্টোমুখী করে দেয়া হলো।
বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট-পরবর্তী সময় থেকে খুব দ্রুতই ১৯৪৭ সালের পাকিস্তানি ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নেয়া হলো। বাংলাদেশে মুসলিম লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হলো। একইভাবে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত অন্যান্য অপশক্তিকে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে দেয়া হলো। মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রাজনীতির মাঠ থেকে হটিয়ে দেয়া হলো। বলা হলো ‘রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করা হবে।’ তাহলে প্রশ্ন জাগে রাষ্ট্র পরিচালনা কে করবে। রাজনীতিবিদরাই যদি রাজনীতির মাঠ থেকে উচ্ছেদ হয়ে যান তাহলে তাদের স্থান কারা পূরণ করবে। এই প্রশ্নের উত্তরে পরিষ্কার যে চিত্রটি পাওয়া যায় তা হচ্ছে পটপরিবর্তন-উত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী, সুবিধাবাদী, আদর্শহীন এবং উচ্চাভিলাসী ব্যক্তিদের সদলে রাজনীতিতে প্রবেশ করে জনগণকে বিভ্রান্ত ও দিকভ্রান্ত করে। ঐ সময়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ অনেকটাই অনুচ্চারিত হতে থাকে, বঙ্গবন্ধুর নাম শুধু নির্বাসিতই নয়, নানা মিথ্যাচারে কলঙ্কিতও করা হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস কেবলই রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা মাত্র ছিল। মাঠে ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালন। অতি ডান অতি বামদের কল্পকাহিনী।
সুতরাং বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নিরলস সংগ্রাম ও ছয় দফার আন্দোলন; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট। পাকিস্তান সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র। এইসব গৌরব গাথা ইতিহাস বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে দেয়া হয়। বলার চেষ্টা করা হয় জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের ত্রাতা এবং ‘সময়ের সাহসী সন্তান’, যিনি ১৯৭৫ সালেও ১৯৭১ সালের মতো নাকি ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এই ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে নির্লজ্জের মতো স্থান করে দেয়া হয়েছে। এখনও বিএনপি এবং এর মিত্র শক্তিরা সেই বানানো বিকৃত ইতিহাসই বারবার উচ্চারণ করে থাকে।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস সংশোধন করলেও ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে চার দলীয় জোট নগ্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ বিরোধী নেতা হিসেবে বারবার আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি রশি টানাটানির লড়াই মল্লযুদ্ধ চলছে। এর একপাশে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করছে অন্যপাশে বিএনপিসহ সকল অতি ডান অতি বাম সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের মিশ্রণে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাসকে নিজেদের আয়ত্বে নেয়ার জন্য টানাটানি করছে।
এখন আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক দেশ, অনেক সংস্থা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকাকে স্বীকৃতি প্রদান করছে। কিন্তু বাংলাদেশে একটি বিরাট অংশে রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধুর নামই উচ্চারণ করে না, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস স্বীকার করে না। অথচ জাতীয় স্মৃতিসৌধ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিস্তম্ভে কেউ কেউ ফুলের তোড়া অর্পণ করলেও স্বাধীনতার অস্তিত্ব স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে। এ ধরনের পরিস্থিতি পৃথিবীর কোন স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জিত রাষ্ট্রে কল্পনাও করা যায় না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, ধর্মের অপব্যাখ্যা, সাম্প্রদায়িকতা, মিথ্যাচার, অপপ্রচার, ইত্যাদি সদর্পে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে দিনরাত চড়ানো হচ্ছে। ফলে নতুন প্রজন্মের তরুণরা শুধু বিভ্রান্তই হচ্ছে না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।