স্টাফ রিপোর্টারঃ
যুব রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রামের মাধ্যমে তখন তাঁর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা শুরু । ১৯৯২ সাল, তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।
এইচ এস সি পর্যন্ত কাজ করেছেন যুব রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রামের হয়ে । তারপর ১৯৯৯ সালে স্কলারশিপ নিয়ে রাশিয়ায় ইলেকট্রনিকস পড়তে যান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত রাশিয়ান রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন । পরে কর্মজীবনে জার্মানিতে ২০০৮ থেকে এখন পর্যন্ত জার্মান রেডক্রসের সাথে যুক্ত আছেন । তিনি দেশে এসেছেন ১৯ বছর পর ।
বলছিলাম প্রকৌশলী জ্যোতির্ময় ধর এর কথা । গত ২৭ মার্চ ২০২০ এ তিনি যুব রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রামের হয়ে মাঠে নামেন। প্রথমে লিফলেট বিতরণ, স্যানিটাইজার বিতরণ করেছেন।
পরে এপ্রিল মাস থেকে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে । এক্ষেত্রে তাঁদের নাম পরিচয় গোপন রেখে, নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে পৌঁছে দিয়েছেন প্রত্যেকের বাসায় ।
রমজান মাস চলাকালীন সময়ে ২০,০০০ মানুষকে পৌঁছে দিয়েছেন ইফতার এবং সেহরি । সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত চট্টগ্রামের ২১ জন গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য পুষ্টিকর ফলমূল সমৃদ্ধ উপহার নিয়ে তাদের খোঁজখবর রেখেছেন জ্যোতির্ময় ।
নিয়মিত খোঁজ খবর রেখেছেন করোনা-আক্রান্ত সাংবাদিকদের। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম সংবাদপত্র কম্পিউটার অপারেটর এসোসিয়েশনের মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া ৫০ জন সংবাদপত্র কম্পিউটার অপারেটরের পরিবারকে ১০ দিনের শুকনা খাদ্য ও মানবিক সাহায্য প্রদান করেছেন তিনি ।
করোনা পরিস্থিতিতে কাজ হারানো ২০ জন সাংবাদিকের পরিবারকে তিনি খাদ্য, মানবিক সাহায্য ও উপহার প্রদান করেছেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে কর্মরত সকল ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী, পিয়ন, নৈশ প্রহরিদের তিনি ঈদ উপহার নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
পাশাপাশি বিশিষ্ট সাংবাদিক তুষার আব্দুল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন “করোনায় তারুন্য” চট্টগ্রামের ত্রাণ কর্মী হিসেবে মাঠে আছেন জোতির্ময় ।
তিনি শুধু চট্টগ্রামেই নয়, ঢাকার স্বেচ্ছাসেবী নাফিসা আনজুম খানের মাধ্যমেও অনেক পরিবারের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি ।
করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফন ও সৎকার কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীদের জন্যও তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন সহায়তার হাত।
এছাড়াও করোনা পরিস্থিতিতে অর্থ কষ্টে থাকা কয়েকটি অনাথ আশ্রম ও এতিমখানায় ও বাড়িয়ে দিয়েছেন মানবকল্যাণে সাহায্যের হাত।
বর্তমানে যুব রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রামের অক্সিজেন সিলিন্ডার সাপোর্ট টিম এর একজন কর্মী হয়েও কাজ করে যাচ্ছেন জোতির্ময়। করোনা আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত পুষ্টিকর ফলমূল, খাবার পানি এবং ওষুধপত্র বিনামূল্যে সরবরাহ করছেন।
তিনি বলেন, “অসহায়রা উপহার পাওয়ার পর তাদের চোখ-মুখ থেকে যে প্রস্ফূটিত হাসির প্রতিফলন ঘটে তখন করোনাকালের সব দুঃখ ক্লান্তি ভুলে যান। এ যেন অপ্রাপ্তির মধ্যে বিশাল প্রাপ্তি । আমরা সবাই যদি এসব বিপদগ্রস্ত প্রাণের ডাকে সাড়া দিয়ে পাশে দাঁড়াই, তাহলে এই যুদ্ধে আমারাই জয়ী হবো ।”
তিনি আরও বলেন, ” মানুষের জন্য কাজ করার সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে মানুষের ভালোবাসা। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যে একটি অনাবিল অানন্দ কাজ করে নিজের মধ্যে।”
৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে তাহলে আমরা কেন অল্প কিছু দিনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারব না।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তবে অদৃশ্য করোনা যুদ্ধ দেখছি। তাই এই যুদ্ধের একজন কর্মী হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি গর্ববোধ করছি।
করোনাকালীন সময়ে ঢাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সিএনজি চালিত একটি অটোরিকশা নিয়ে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বাড়িতে বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন নাফিসা আনজুম খান। এই ক্রান্তিলগনে দেশের মানুষের জীবন জীবিকা স্থবির, তাই তিনি নিজস্ব উদ্যোগে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন অসহায় মানুষের মাঝে। সপ্তাহে দুই দিন তিনি খাবার বিতরণ করেন।
অসহায়, দুস্থ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারগুলোকে ঘরেঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়াসহ জীবনের ঝু্ঁকি নিয়ে আজ অবদি মানবসেবায় কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
নাফিসা ও তার পরিবারের অর্থ দিয়েই এই মহতী উদ্যোগের সূচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি পোস্ট করেন তার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে কেউ আগ্রহী কিনা। অবশ্য খুব দ্রুত তিনি স্বেচ্ছাসেবক পেয়েও যান। ইতোমধ্যে নাফিসা তার মুঠোফোনের নম্বরটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেন, কারও খাবার দরকার হলে যেন তাকে অবগত করাতে পারেন। তার বাসার সামনেই চলে খাবার তৈরি ও প্যাকেট করার কর্মযজ্ঞ।
কিন্তু এই লকডাউনে মানুষ দূর থেকে তার বাসায় আসতে পারত না। তাই তিনি কালবিলম্ব না করে নিজেই একজন সিএনজি অটোরিকশা জোগাড় করলেন। অটোরিকশা চালক নিজেও খুশি এই মহতী উদ্যোগে নিজেকে শরিক করতে পেরে।
তিনি অটো রিকশা চালক নিজেও খুশি এই মহতী উদ্যোগে নিজেকে শরিক করতে পেরে। তিনি অটোরিকশার সামনে একটি কাপড়ের মধ্যে লিখে দিলেন ‘বিনা মূল্যে খাবার সরবরাহ, পরিচালনায় নাফিসা আনজুম খান, একজন বাংলাদেশ’। এর পর আস্তে আস্তে সাহায্যের জন্য মুঠোফোনে খুদে বার্তা আসার সংখ্যাও বেড়ে গেল। প্রথম দিকে সবাইকে খাবারগুলো ঠিকমতো দিতে অসুবিধা হচ্ছিল তার, কারণ তিনি বুঝতে পারলেন একই পরিবারের অনেকে দুবার করেও খাবার নিয়ে যাচ্ছিলেন।
তাই যারা আগে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন, তাদের নম্বারে কল করে নিশ্চিত হয়ে তিনি খাবার বিতরণ করেন। তবে নাফিসার চিন্তার ক্যানভাস আরও বড়, তার মতে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও এই সময় আর্থিক সংকটের মধ্যে যাচ্ছেন যারা সাহায্যের কথা লজ্জায় মুখে বলতে পারেন না। তাই এদের কথা ভেবে তিনি খাবার বিতরণের সময় ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচার করছেন না। তবে নাফিসা ও তার পরিবারের একার পক্ষে এ কাজ সামনে এগিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। তাই এ সময় নাফিসার পাশে এসে দাঁড়াল তার সাবেক কর্মস্থল গ্রামীণফোনের সহকর্মীরা।
এ ছাড়া বর্তমান কর্মস্থল সিনি কেয়ার বাংলাদেশ নামক একটি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানির সহকর্মীসহ বন্ধুস্বজন অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। তবে গত সপ্তাহে তিনি সামিট গ্রুপের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকেও একটা ফান্ড পেয়েছেন। নাফিসা খান বলেন ‘অনেকেই আছেন যারা দরিদ্র ও অনাহারে থাকা মানুষদের সাহায্য করতে চাচ্ছেন। তারা যদি বাইরে গিয়েও সাহায্য করতে না পারেন তা হলে আমাকে বললেও আমি সেটার দায়িত্ব নিতে পারব।‘ নাফিসা খান বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। গণমাধ্যমে এ সংবাদ পেয়ে তার মহৎ উদ্যোগে সামিল হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয় দলের ওয়ানডে সংস্করণের অধিনায়ক তামিম ইকবাল খান।
তামিমের দেওয়া উপহার অসহায় পরিবারে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন ‘একজন বাংলাদেশ’। তামিমের উপহারের প্যাকেটের ছবি সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করে নাফিসা লিখেছেন, ‘ক্যাপ্টেনের উপহার নিয়ে রওনা হচ্ছি…’ মূলত, যে সকল পরিবার নাফিসার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাদের কাছে সিএনজিতে চড়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেন নাফিসা। সিএনজিতে একটি ব্যানারে লেখা থাকে ‘একজন বাংলাদেশ’। শুরুতে কারও সাহায্য নেননি। তার মহৎ উদ্যোগ দেখে কাছের মানুষরাও তার সঙ্গে যোগ দেন। সে ধারায় গণমাধ্যমে বরাতে জানতে পেরে তার সঙ্গে সামিল হোন টাইগার অধিনায়কও।
করোনাকালে দেশের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া ঢাকা-চট্টগ্রামের দুই তারুণ্যের কান্ডারী প্রকৌশলী জ্যোতির্ময় ধর ও নাফিসা অঞ্জুম খান প্রকৃতই মানবসেবী হিসেবে দেশের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া ব্যক্তিত্বের কার্যক্ষমতা অবিরত থাকুক।