মোরশেদুল হক আকবরীঃ
দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য পরিচালনায় বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে পণ্যের জাহাজীকরণে। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ চেইনে অস্থিতিশীল পরিবেশ জাহাজীকরণ ব্যয়কে বাড়িয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। এ সংকট মোকাবেলায় উৎপাদনমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে যুক্ত বড় গোষ্ঠীগুলো নিজেরাই এখন বিদেশ থেকে জাহাজ কিনে পণ্য পরিবহন শুরু করেছে। বিশেষ করে গত তিন বছরে বড় অংকের বিনিয়োগও হয়েছে এ খাতে। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে সমুদ্রে পণ্যবাহী জাহাজ ভাসালেই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ওপর কর ছাড় পাবেন এমন সিদ্ধান্ত এ খাতের উদ্যোক্তাদের আরো বড় পরিসরে বিনিয়োগের পথ খুলে দিয়েছে।
প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ওপর কর ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে সমুদ্রগামী স্থানীয় জাহাজ থেকে আয়ের ওপর ৩ শতাংশ হারে কর দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আসন্ন অর্থবছর সামনে রেখে ৩-৪ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করমুক্ত করার এ প্রস্তাব স্থানীয় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এমনটাই জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ কর্তৃক বহির্বিশ্বে সেবা প্রদানের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাংকিং চ্যানেলে আনীত আয়কে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করমুক্ত করার প্রস্তাব করছি। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে রফতানি খাতকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে সমুদ্রপথে পরিচালিত হয়। সমুদ্রপথে আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানে ১৫০টিরও বেশি দেশ থেকে পণ্য আনা হচ্ছে। এর মধ্যে গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৮২২ কোটি টাকার পণ্য। যার ৫৩ শতাংশই আনা হয়েছে চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে।
চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান এ বিষয়ে বলেন, ‘সরকারের অব্যাহত নীতিসহায়তা দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের বহরকে বড় করে তুলবে। বন্দরেও দ্রুত জাহাজ দ্রুত ভেড়ানোর ব্যাপারে নিয়ম অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাবে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজগুলো।’
বাংলাদেশে নিবন্ধিত সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মালিকানা রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের (এস আর শিপিং) । তাদের কাছে রয়েছে ২৩টি জাহাজ। তবে দেশে ইস্পাত খাতের প্রথম সারির এ প্রতিষ্ঠানটি সমুদ্রগামী জাহাজে এখন নতুন বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে।
কেএসআরএমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম এ প্রসঙ্গে একাত্তর বাংলা নিউজকে বলেন, ‘বাজেট প্রস্তাবে সরকার সমুদ্রগামী জাহাজে বিনিয়োগের বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। গার্মেন্টস রফতানি আয় আনলেও তাদের ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে অনেক অর্থ চলে যায়। কিন্তু আমাদের এ খাতে একেবারে নিট ইনকাম। ফলে আমরা দেশীয় পণ্য পরিবহনে আয়ের ওপর ৩ শতাংশ কর প্রত্যাহার চেয়ে আসছিলাম। কারণ এটা অসহনীয় ছিল। সরকারের ইতিবাচক সাড়ায় এখন এটার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবে। খাতটিকে সুবিধা দেয়ার অর্থ হলো বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা। আমাদের হাতে এখন ২৩টি সমুদ্রগামী জাহাজ আছে। সবকিছু অনুকূলে থাকলে দ্রুতই আরো নতুন সমুদ্রগামী জাহাজ নামানোর পদক্ষেপ নিচ্ছি আমরা।’
কেএসআরএম ছাড়াও মেঘনা গ্রুপের রয়েছে ১৬টি জাহাজ। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের এ শিল্প গ্রুপটি নতুন করে সাতটি জাহাজ নামানোর পরিকল্পনা করছে। অন্যান্য শিল্প গ্রুপের মধ্যে আকিজ গ্রুপের রয়েছে ১০টি জাহাজ। কর্ণফুলী লিমিটেডের ছয়টি। কর্ণফুলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনস সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ পরিচালনা করছে। এর পর পরই বসুন্ধরা গ্রুপের পাঁচ, বিএসএ গ্রুপের পাঁচ, এজেএল বাংলাদেশের তেল পরিবহনকারী দুটি জাহাজ, সিমেন্ট খাতের কোম্পানি এমআই সিমেন্টের কাছে রয়েছে তিনটি জাহাজ। বেসরকারি শিল্প গ্রুপের বাইরে ছয়টি নতুন জাহাজ সংগ্রহের পর বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বহরে এখন যুক্ত আছে আটটি সমুদ্রগামী জাহাজ।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট ও সি-কম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আমিরুল হক একাত্তর বাংলা নিউজকে বলেন, ‘সমুদ্রগামী জাহাজের বিনিয়োগে উৎসাহী করতে সরকার বাজেটে যে প্রস্তাব করেছে এটা একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এখন অনেক বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। জাহাজ ভাড়া যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে আমি হিসাব করে দেখেছি গত দুই বছরে আমরা যে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করেছি, সেখানে ৬০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত দিয়েছি।’
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন একাত্তর বাংলা নিউজকে বলেন, ‘পণ্যবাহী সমদ্রগামী জাহাজ পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। যার কারণে সাগরে পণ্য পরিবহনে বিদেশী জাহাজ ভাড়া করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে সরকারের সহায়তা পেয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের এ খাতে বিনিয়োগের যে উৎসাহ তৈরি হয়েছে, সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর নিয়ে আসবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানও হবে।’