এম.এইচ মুরাদ:
চট্টগ্রামের দু’টি গুদাম থেকে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের নানা ধরনের গার্মেন্টস কাপড় জব্দ করেছে র্যাব ও বন্ড কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নগরীর সুপারি পাড়া এলাকায় ইয়োলো সিন্ডিকেটের দুটি গুদামে অভিযান চালিয়ে কাপড়গুলো জব্দ করা হয়। তবে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে কি না তা তদন্তের পর জানা যাবে বলে জানিয়েছে বন্ড কাস্টমস।
র্যাব এবং বন্ড কাস্টমসের কাছে তথ্য ছিল, গার্মেন্টসের কাপড় এনে গুদামজাত করা হয়েছে নগরীর দেওয়ানহাট সুপারি পাড়া এলাকায়। এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে দুপুরে যৌথভাবে ইয়োলো সিন্ডিকেটের দুটি গুদামে অভিযান চালানো হয়। যেখানে পাওয়া যায় শার্ট, প্যান্ট, থান কাপড়সহ নানা ধরনের গার্মেন্টস কাপড়। তাদের ধারণা বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আনা হয়েছে এসব কাপড়।
চট্টগ্রামের কয়েকটি বাজারে প্রতিদিন বানের পানি মতো ঢুকছে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা বিদেশি কাপড়। অথচ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা এসব কাপড় শতভাগ রফতানিমুখী গার্মেন্টেস ব্যবহার করার কথা। কিন্তু গার্মেন্ট মালিক নামধারী দেশের স্বার্থবিরোধী একটি চক্র এসব কাপড় কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি শক্তিশালী চক্র। যারা অন্যের বন্ড লাইসেন্সে মোটা অংকের কমিশনের বিনিময়ে চুটিয়ে এই চোরাকারবারির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শুধু দেশের সম্ভাবনাময় টেক্সটাইল বা বস্ত্র খাতই ধ্বংস হচ্ছে না, সরকারও হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু বন্ডের কাপড় চোরাচালান করেই শূন্য থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন অনেকে। যাদের মধ্যে কেউ কেউ এক সময় ছিলেন হকার, সেলসম্যান কিংবা প্রবাসী শ্রমিক। এই সোনার হরিণের পেছনে ছুটে খুব কম সময়ের মধ্যে তারা এখন সমাজের উঁচু তলার মানুষ বনে গেছেন।
খোদ চট্টগ্রামের ইপিজেডে চোরাই কাপড়ের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে দিনের পর দিন প্রশাসনের নাকের ডগায় এতবড় অপরাধ সংঘটিত হলেও রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন চোখ-কান বন্ধ করে বসে আছে। অথচ এর নেতিবাচক প্রভাবে দেশের টেক্সটাইল খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বন্ডেড সুবিধায় আনা বিভিন্ন শ্রেণীর কাপড় চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটে দেদারছে ঢুকে পড়ায় দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কাপড় অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে।
বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধাভোগী এই চক্রের ফাঁদে পড়ে দেশের শিল্প বিনিয়োগে বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, শুল্ক ও করমুক্ত এবং মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি হওয়া সুতা কাপড়সহ বিভিন্ন পোশাক পণ্য অবাধে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের রফতানিমুখী স্পিনিং ও উইভিং মিলগুলোতেও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি রীতিমতো দেশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত। এছাড়া পোশাক শিল্পের মালিক নামধারী এক শ্রেণীর প্রভাবশালী চোরাকারবারি এদের প্রধান সহযোগী। যারা দেশের স্বার্থবিরোধী এই কালোপথে প্রতিদিন বিপুল অংকের কাঁচা টাকা পকেটস্থ করছে। যার ভাগ চলে যাচ্ছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে সহায়তাকারী পর্দার আড়ালে থাকা গডফাদারদের কাছে।
বিশ্লেষক ও ভুক্তভোগী শিল্প উদ্যোক্তারা বলেন, রক্ষকরা এখানে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যে কারণে দিনেদুপুরে ডাকাতি হওয়ার মতো এ রকম রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের বিষয়ে আজ অবধি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো কিছু অভিযান ও মামলা হয়। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তারা বলেন, এখনও বন্ডের সীমাহীন এই অপব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব না হলে টেক্সটাইল খাতের অবশিষ্ট যা আছে তা অচিরেই গ্রাস করে ফেলবে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, কেবলমাত্র চোরাই কাপড়ের কারবার করেই শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন এমন লোকের সংখ্যা এখন অনেক। এদের মধ্যে শীর্ষ তালিকায় আছেন চট্টগ্রামের ইয়েলো সিন্ডিকেটের প্রধান মোঃ আইয়ুব। তার সহযোগী হিসাবে আছে টিপু, শামশু, কার্তিক সহ অনেকে।
সূত্র বলছে, বন্ডের কাপড় চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে খালাস হয়ে ঢাকার আশপাশে এসে নামে। রাতের অন্ধকারে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় গাড়ি আনলোড হয়। এজন্য চট্টগ্রাম রোডে অনেক বাড়িতে অস্থায়ী গোডাউনও গড়ে উঠেছে। এসব গোপন গোডাউন থেকে সুবিধামতো সময়ে কাপড় হাতবদল হয়।
এক পর্যায়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এগুলো চলে যায় ইসলামপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে কালোবাজারিদের হাতে। সেখান থেকে গোপনে ঢুকে পড়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের ফ্যাক্টরিতে। আবার প্রতিদিন রাত ১২টার পর অবৈধ কাপড় বোঝায় ট্রাক বিভিন্ন কোম্পানির ওয়্যার হাউস থেকে সরাসরি ইসলামপুর ও সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে চলে আসে। এর মধ্যে সদরঘাটের বিক্রমপুর সিটি গার্ডেন মার্কেট অন্যতম।
এখানে প্রায় ৬০ শতাংশ কাপড়ই বন্ডেড সুবিধা নিয়ে আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া ইসলামপুরের নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, কে হাবিবুল্লাহ মার্কেট ও ইসলাম প্লাজাতে এভাবে আনা ৮০ শতাংশ সুতা ও কাপড় বিক্রি হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এর সঙ্গে ইপিজেডগুলোর কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এখানকার কতিপয় ব্যবসায়ী চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কিছু পরিমাণ কাপড় শুল্ক দিয়ে আমদানি করেন। তারা এই ভ্যাট চালানের রসিদ ব্যবহার করে বন্ড সুবিধায় আনা বিপুল পরিমাণ কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করে থাকেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অনেকটা প্রকাশ্যেই এখন চোরাই কাপড় বহন করা হচ্ছে। তবে এজন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে। চোরাই কাপড়ভর্তি যানবাহনকে যাতে কোথাও কোনো তল্লাশির মুখে পড়তে না হয় সেজন্য কোটি টাকায় সরকারি রাস্তা কিনে নেয় চোরাকারবারিরা।
এই পদ্ধতিকে রুট ক্লিয়ারেন্স বলা হয়। অর্থাৎ রাস্তায় দায়িত্ব পালনকারী বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এমনকি তাদের মাধ্যমেই আগে থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে চোরাই কাপড় ভর্তি যানবাহন গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়।
সূত্র বলছে, এ প্রক্রিয়ায় ক্লিয়ারেন্স পেলে কাপড়ের আড়তে সরাসরি লরি গিয়ে ঢোকে। ৪০ ফিট এবং ২০ ফিট লরি প্রকাশ্যে আনলোড হয়। আবার অনেক সময় ঢাকার আশপাশে লরি ঢুকে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাত গভীর হলে ছোট ছোট ট্রাকে অথবা কাভার্ড ভ্যানে আনলোড করার পর সেগুলো বিভিন্ন মাকের্টে চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চোরাই কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা দালালদের মাধ্যমে আগেই লাইন ঠিক করে রাখি। লাইনম্যান নামের এক শ্রেণীর দালাল প্রসাশন খরচ হিসাবে প্রতিমাসেই টাকা নেয়। লাইনম্যানরা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। তারাই খুঁজে বের করে কোন অফিসার কোন এলাকার দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সৎ না অসৎ তাও খুঁজে বের করে দালালরাই ঘুষের টাকা পৌঁছে দেয়।’
সূত্র বলছে, চোরাই কাপড় ব্যবসা থেকে বিভিন্ন সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পকেটেও ঘুষের টাকা পৌঁছে যায়। এমনকি বিজিএমইএ’র কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত এই কারবার থেকে ঘুষ আদায় করেন। কারণ অনেক গার্মেন্ট মালিকের মূল ব্যবসাই হল এই আন্ডারগ্রাউন্ড চোরাই কাপড়ের ব্যবসা। কোনোমতে ২০-২৫টি মেশিন বসিয়ে তারা ভুয়া উৎপাদন দেখায়। কিন্তু আড়ালে চোরাই কাপড়ের ব্যবসাই হল প্রকৃত ধান্দা।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু ইসলামপুরেই বছরে অন্তত ১০ হাজার কনটেইনার কাপড় আসে। এছাড়াও রাজধানীর আরও কয়েকটি জায়গায় চোরাই কাপড়ের গোপন বাজার গজিয়ে উঠেছে। তবে এই দুর্নীতির শুরুটা হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে কনটেইনার খালাস করা হয়। এরপর ঘাটে ঘাটে অবৈধ টাকার লেনদেন হয়। বন্ডের অবৈধ কারবার থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারদের পকেটেও বিপুল অংকের ঘুষ যায়।
দুদক কাস্টম হাউসের সাবেক কয়েকজন কমিশনারের তদন্ত করতে গিয়ে রীতিমতো হতবাক হয়ে যায়। তারা জানতে পারে, দেশে ও বিদেশে তার বিপুল অংকের যে অর্থসম্পদ রয়েছে তার বেশিরভাগই এসেছে বন্ডের সুবিধার গোপন কমিশন থেকে।
সম্প্রতি অন্যত্র বদলি হওয়ায় একজন কমিশনারের কথিত ক্যাশিয়ার জনৈক হারুণও ঢাকায় অন্তত ৫টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। চলাফেরা করেন পাজেরো গাড়িতে। এতেই অনুমান করা যায়, বন্ড সুবিধায় কাপড়সহ অন্যান্য পণ্য এনে কী পরিমাণ টাকার ছড়াছড়ি হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বন্ড কাপড় চোরাই বাজারে বিক্রির পাশাপাশি কাস্টম হাউসের নিলাম কাগজ দেখিয়েও বড় ধরনের জালিয়াতি হয়। একবার নিলামে কাপড় কিনে ৪-৫ দফা চোরাই কাপড় নিলামের বলে বীরদর্পে চালিয়ে দেয়া হয়। কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় কালোবাজারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।
আরো বিস্তারিত আসছে পরবর্তী রিপোর্টে….