এম.এইচ মুরাদঃ
সমাজে প্রতিটি পেশারই স্বকীয় গুরুত্ব রয়েছে। একজন কৃষক যেমন দেশের জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদনে কাজ করেন, একজন শিক্ষক যেমন জাতিগঠনে ভূমিকা রাখেন, একজন গৃহিণী যেমন ভবিষ্যত প্রজন্মকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেন, তেমনি প্রত্যেকেই তাদের নিজের কাজ ও অবদানের মাধ্যমে সমাজকে সচল রাখে। বর্তমানের আধুনিক জাতি রাষ্ট্রভিত্তিক পৃথিবীতে ব্যবসায়ীরা এমনিভাবেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তারা অর্থনীতির চাকাকে চালু রাখেন, একই সাথে তারা বেসরকারী খাতে দেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশের জন্য কর্মের যোগান দিয়ে থাকেন। আজকে এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে দেশের এমন একজন কৃতি ব্যবসায়ী ও প্রকৃত সমাজদরদী মানুষকে উপস্থাপন করবো, যিনি তার কর্মজীবনে সফলতার পাশাপাশি সামাজিক ও সেবামূলক কাজেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। যার সামাজিক কর্মকান্ডের পরিধি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের মাঝেও প্রসারিত হয়েছিলো। যিনি একজন দূরদর্শী মানুষ হিসেবে উপলদ্ধি করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক প্রবাসীদের গুরুত্ব এবং সম্ভাবনাকে।
যার কথা বলছিলাম তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের সবার প্রিয় প্রকৃত সমাজদরদী ও দানবীর শিল্পপতি মরহুম আলহাজ্ব হাসান মাহমুদ চৌধুরী। যাকে আমরা গত বছরের এই সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখে চিরতরে হারিয়েছিলাম।
জনাব হাসান মাহমুদ চৌধুরী সিআইপি চট্টগ্রামের রাউজান থানায় এক সম্ভান্ত্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর নির্ভর বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত থাকলেও তার প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে ঢাকা, যশোর, খুলনা সহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে। কেবল ব্যবসায়ী হিসেবেই নয়, বরং শিক্ষাজীবনেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি অত্যন্ত সফল ছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবি সংগঠনে প্রদত্ত তার বক্তব্যে ফুটে উঠে একজন সমাজ ও ইতিহাস সচেতন মানুষের চিন্তাভাবনা। তিনি বারবার দেশ ও দেশের মানুষের কথাই সব জায়গায় বলতেন এবং মানুষের উপকার করতে পারলেই তিনি সুখী হতেন। তার দেয়া অনবদ্য এবং চিন্তাশীল বক্তব্যগুলো থেকে বুঝা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ ও পর্যবেক্ষণের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ হয়েছিলো কল্পনাতীত। একই সাথে দেশ ও মানুষের জন্য ভালোবাসার কারণে ব্যবসার পাশাপাশি মানবাধিকার, সমাজকল্যাণ, ধর্মের ইতিবাচক ভূমিকা ও মুক্তচিন্তার মতো প্রয়োজনীয় বিষয়েও তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মতো।
পেশাগত জীবনে হাসান মাহমুদ চৌধুরী সিআইপি কে-এন হারবার কনসোর্টিয়াম নামের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক বিশাল প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর এ কোম্পানী সামুদ্রিক পরিবহন, লজিস্টিক অপারেশন এবং বিভিন্ন দেশে কাস্টম ক্লিয়ারিং এর কাজ করে থাকে। খনিজ সম্পদ আহরণ, পরিবহন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবস্থাপনার মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত। হেলিবার্টন, গাজপ্রম, বাপেক্স, সিমেন্স এর মতো বাংলাদেশী ও আন্তর্জাতিক অনেকগুলো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সাথে রয়েছে এর ব্যবসায়িক সম্পর্ক। তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক প্রকৌশলী, ভূতাত্বিক গবেষক ও বিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নকর্মে অবদান রাখার সুযোগ পাচ্ছে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি প্রচুর ব্যবসায়ী সংগঠনের সক্রিয় নেতৃত্বে অংশ নিয়েছেন যা দেশের খুব অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের ভাগ্যে জুটেছে। এর মাঝে বাংলাদেশ মাস্টার্স স্টিভিডোর্স এসোসিয়েশন, ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার্স অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, ডাচ-বাংলা চেম্বার্স অফ কমার্স, চিটাগাং পোর্ট ইউজার্স ফোরাম, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার্স অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। দেশের অর্থনীতি এবং ব্যবসাক্ষেত্রে হাসান মাহমুদ চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে একজন সি.আই.পি অর্থ্যাৎ কমার্শিয়ালি ইম্পরটেন্ট পার্সন এর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলো।
পাশপাশি সামাজিক কল্যাণে এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের সাহায্যের জন্যও হাসান মাহমুদ চৌধুরী সবসময় কাজ করে গেছেন অকাতরে। তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একজন লাইফ মেম্বার ছিলেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন কাশেম-নুর ফাউন্ডেশন নামের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এবং দরিদ্রদের জন্য ত্রাণ বিতরণ সহ নানা ধরণের সেবামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। বিভিন্ন উপলক্ষে দরিদ্রদের জন্য সাহায্য প্রদান এবং এতিমখানার মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সহায়তার জন্য কাশেম-নুর ফাউন্ডেশন ইতিমধ্যে সমাজকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত এম্বুলেন্সে অসুস্থ ব্যক্তিদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার একটি চমৎকার কার্যক্রমও অসংখ্য মানুষের উপকার করে যাচ্ছে।
এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি হাসান মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রামের চাঁদগাও আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সফল সভাপতি হিসেবে সক্রিয় ভাবে চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের সেবায় কাজ করে গেছেন। তাঁর বিভিন্ন উদ্ভাবনী সিদ্ধান্ত ও কাজের ফলে এ এলাকার মানুষেরা স্বাস্থ্যসেবা, সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ, উপযুক্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সহ বিভিন্ন ধরণের উপকার পেয়েছিলো।
হাসান মাহমুদ চৌধুরী সিআইপি সবসময় সাংবাদিক বান্ধব মানুষ ছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় নিষ্ঠা ও সততার কথা উল্লেখ করে বলতেন সাংবাদিকরা হলেন সমাজের কলম যোদ্ধা ও সমাজের আয়না। সাংবাদিকরা সমাজের চেহারা মানুষের সামনে তুলে ধরেন, এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সবার সামনে প্রতীয়মান হয়। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সত্যান্বেষী ও মানবতাবাদী সাংবাদিকদের বিশেষ ভুমিকাকে সবসময় শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তিনি নিজে অনেক মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমের সাথে জড়িত ছিলেন, তাদের সুখ-দুঃখে পাশে থাকতেন অভিবাবক হিসেবে।
প্রকৃতপক্ষে হাসান মাহমুদ চৌধুরীর মতো মানুষগুলোই নিজ নিজ অবস্থানে সফল হয়ে দেশ ও সমাজের জন্য ইতিবাচক অবদান এবং ভূমিকার এক উদাহরণ হিসেবে সবার সামনে হাজির হয়। বিভিন্ন দেশের নামকরা ব্যবসায়ীদেরকে আমরা দেখি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের কাজের সীমানা সম্প্রসারণ করে তাদের দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন তাদের প্রতিভা ও কঠোর সাধনা দিয়ে। ঠিক তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী অনেক বাংলাদেশি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায়িক পরিধি আন্তর্জাতিকভাবে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশের নাম বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন তাদের মধ্যে হাসান মাহমুদ চৌধুরীও একজন।
হাসান মাহমুদ চৌধুরী এখন আমাদের মাঝে আর নেই কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তার আদর্শ ও সততার এক নিদর্শন। যা থেকে গ্রহণ ও শিখার মতো আছে অনেক কিছু। তার বড় ছেলে জুবায়ের হাসান চৌধুরী ও বড় মেয়ে ব্যরিস্টার সুমাইয়া হাসান চৌধুরী এখন হাল ধরেছেন বাবার ব্যবসাসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ডের। আশা রাখছি কর্মবীর হাসান মাহমুদ চৌধুরী সিআইপির মতো তারাও সফলভাবে এগিয়ে যাবেন নিদিষ্ট লক্ষ্যে। তাদের মেধা, কর্ম, আদর্শ এবং সফলতায় হয়ে উঠবেন আমাদের কাঙ্খিত এক সফল বাংলাদেশের প্রতিনিধি। যাদের কর্মযজ্ঞে বাংলাদেশ সুন্দর এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। তাদের মাধ্যমে ষোল কোটি মানুষের মধ্যে বঞ্চিত এবং অভাবী অংশটির একটি অংশ পাবে সুন্দর, সম্মানিত জীবনযাত্রা এবং কর্মের নিশ্চয়তা। এই কল্যাণমূলক উন্নয়নের পথে আপনারা যেভাবে হাসান মাহমুদ চৌধুরী সিআইপির সাথে ছিলেন ঠিক তেমনি তার ছেলেমেয়ে এই তরুণ উদ্দোক্তা ও সমাজসেবকদের সফলতার জন্য পাশে থাকবেন এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। পরিশেষে সবার প্রিয় মানুষ মরহুম হাসান মাহমুদ চৌধুরী সিআইপির জন্য সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি ও মহান আল্লাহর দরবারে তার সকল ভালো কাজের উছিলায় তাকে জান্নাতের উচ্চতম মাকাম দানের জন্য ফরিয়াদ করছি, আমীন।