ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুকঃ
চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের একজন কৃতিপুরুষ, অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অন্যতম কর্ণধার হাসান মাহমুদ চৌধুরী সিআইপি আমাদের কাছে আর কোন দিন ফিরে আসবেন না, তিনি চলে গেছেন এক অজানা, অচিন দেশে। এভাবেই আমাদেরকেও চলে যেতে হবে, যার কোন নেই সীমানা। যেখান থেকে শুরু হবে কেয়ামতের শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিক্ষা। গতবছর করোনা মহামারী যখন শুরু হয়ে গেল, তখন বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছল ব্যক্তিবর্গ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল করোনা প্রতিরোধের অগ্রযাত্রায়।
আর এই অগ্রযাত্রায় সামিল হয়েছিলেন মানবদরদী স্বয়ং হাসান মাহমুদ ভাই। তিনি ছিলেন একাধারে ব্যবসায়ী নেতা, শিল্পপতি, একজন প্রচারবিমুখ সমাজসেবক। তিনি বৈদেশিক বিভিন্ন চেম্বারের দায়িত্ব পালনও করেছিলেন। ব্যবসায়ী হিসেবে এদেশের বিভিন্ন অঙ্গনে যথেষ্ট খ্যাতির স্বাক্ষর রেখে গেছেন। করোনা অতিমারি মোকাবেলায় গরীব ও নিঃস্বজনের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন মানবতার মূর্তপ্রতীক হিসাবে। করোনার তান্ডব শুরু হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভয়াবহতা বিরাজ করছিলো তা মোকাবেলার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন এই নির্লোভ নিরহংকার মানুষটি। তিনি তার ব্যক্তিগত অনুদান থেকে একটি বিরাট অংশ অকাতরে দান করেছিলেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ফিল্ড হাসপাতাল ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে। হাসান মাহমুদ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় সেই স্কুল জীবন থেকেই। আমি তখন রাউজান ছালামত উল্লাহ হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। যে কোন একটি অনুষ্ঠানে রাউজান কলেজে এসেছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। তখন চাকসুর শাহজালাল হলের নির্বাচিত জিএস ছিলেন তিনি।
১৯৮১ সালের ঘটনা। শুভ্র ও সৌম্য, ছোটখাটো এই সুন্দর মানুষটিকে প্রথমে দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। আমি নিজেই তার সাথে পরিচিত হই। এরপরে দীর্ঘজীবন কেটে গেছে।১৯৯০ সালে রাউজান রাঙ্গুনিয়া নিজাম উদ্দিন পাবলিক হল মিলানায়তনে আমরা ক’জনার প্রতিষ্ঠিত শারীরিক কসরত সম্পর্কিত ক্রীড়াবির্তীক সংগঠন মার্শাল ড্রাগনের প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। তখন খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম এই মানুষটাকে। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি একজন নিবেদিত পুরুষ হিসেবে তার ভূমিকাকে আমি বুঝেছি, উপলব্ধি করেছি গভীর হ্নদ্যতার সাথে। সেই প্রোগ্রামের জন্য বড় অনুদান দিয়েছিলেন তিনি। এরপরে আর থেমে থাকেনি সময়। মার্শাল ড্রাগন ক্লাবটি পরিচিত হয়ে রাউজান ক্লাবে পরিচিত হয় একসময়। রাউজান ক্লাবের প্রতিটি অনুষ্ঠানে, প্রতিটি পদক্ষেপে তার সহযোগিতা সমৃদ্ধ করেছে আমাদের মন ও মনন। রাউজান ক্লাব যাকাত তহবিল ও প্রস্তাবিত রাউজান ক্লাব জেনারেল হাসপাতাল তাঁর বড় অংকের অনুদান ভুলে যাওয়ার নয়।
গত বছরের করোনা মহামারীতে আমি যোগাযোগ করেছিলাম তাঁর সাথে। তিনি সাথে সাথে রাউজান ক্লাব ত্রান তহবিলে ১২৫ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী প্রদান করেছিলেন। গতবছরের করোনা যুদ্ধে সবাই যখন সম্মূখসারির যোদ্ধা, তিনিও তাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে এই ভয়াবহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন অবলীলাক্রমে।
করোনাকালীন সময়ে কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি তার কাছে সহযোগিতা চেয়ে বিফলে যাননি এইটাই হাসান ভাইয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ২০২০ সালের ভয়াবহ করোনা যুদ্ধে এই লড়াকু সৈনিক অবশেষে করোনার কাছে হার মানলেন অতি নিরবে, জীবনের উপার্জিত অর্থের অর্থাৎ অধিকাংশ ব্যয় করেছেন মূলত সমাজসেবায়। প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেকগুলা এতিমখানা, মসজিদ, মেডিকেল সেন্টার। ঢাকায় ও এই ভয়াবহ করোনার সময় প্রতিষ্ঠিত করেছেন ফিল্ড হাসপাতাল যা ছিল ১০০ শয্যা বিশিষ্ট।
চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মা ও শিশু হাসপাতাল ও রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ অসংখ্য চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেকে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত করে রেখেছিলেন। ঘুণেধরা এই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। সমাজ ও ব্যক্তির কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল ঈর্ষণীয়। দেশের শীর্ষ শিল্পপতিদের তালিকায় তার অবস্থান ছিল অতি উঁচুতে। এরপরও তার মধ্যে ছিল না কোন অহমিকা,অহংকারের বেড়াজাল। তিনি প্রচুর অর্থ বৃত্তের মালিক হয়েও সব কিছুই বিলিয়ে দিয়েছেন মানবিক কর্মকাণ্ডে ও অসহায়দের মাঝে। একজন প্রতিষ্ঠিত বিসনেস ম্যাগনেট এখন সমাজে দুর্লভ। তিনি থাকবেন দুঃখী মানুষের মানসপটে, মেহনতী গণমানুষের চেতনায় তিনি থাকবেন অবিনশ্বর। মাত্র ৬১ বছর হায়াত পাওয়া এই মানুষটি রাউজানের কদলপুর নিবাসী প্রাক্তন সিভিল সার্জন মরহুম ডাক্তার আবুল কাশেম এবং রত্নাগর্ভা মা মরহুমা নুর মহল খান এর সুযোগ্য সন্তান। দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে তার পরিচিতি ছিল সবার শীর্ষে। চট্টগ্রাম বার্থ এন্ড শীপ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, চিটাগাং পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সদস্য, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের ডাইরেক্টর, ডাচ-বাংলা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের মেম্বার, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের মেম্বার, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস এসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের আজীবন সদস্য, চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড ও চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন এই নিরহংকার ব্যক্তিত্বময় মানুষটি। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন এই জাগতিক জীবনের এক আলোকিত মানুষ, উম্মেষময় বাতিঘর। স্থায়ী জীবনের সান্নিধ্যে আমরা চাই এই মানুষটি যেন তায়ালার প্রতিটি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন।
দুনিয়ার নেক আমলের প্রতিটি অনু-পরমানু যেন তার পরকালীন জীবনের নাযাতের উছিলা হয়। আর আমরা কায়মনোবাক্যে ব্যতিক্রমী মানুষটির জন্য মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের কাছে জান্নাতের উচ্চতম মাকামে স্থান দেওয়ার হ্নদয় অবরিত দোয়া করছি। আমীন।