স্টাফ রিপোর্টারঃ
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে খুলে গেলো সাফারি পার্কের দরজা। চোখ আঁধারে মানিয়ে নিতেই দেখলেন, নিশাচর প্রাণীরা আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে তাদের রহস্যময় আবাসস্থলে। চারপাশে উন্মুক্ত বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, বন হরিণ হেঁটে বেড়াচ্ছে আর আপনি মিনিবাসে চড়ে ঘুড়ছেন। হঠাৎ একদল বণ্যপ্রাণী এসে আপনার পথ আটকে দিলো, জানালার কাছে এসে গর্জন দিলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার!
কল্পনার এই গা ছমছমে এ দৃশ্য আপনি হয়তো হলিউডের মুভিতে দেখে থাকবেন। তবে বাস্তবে আপনাকে সে অনুভূতি দিতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে নির্মিত হতে যাচ্ছে সিঙ্গাপুরের মান্দাই এর আদলে ‘নাইট সাফারি পার্ক’। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ পরিকল্পনা করেছে। ইতোমধ্যেই সাফারি পার্ক নির্মাণে নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এটির নির্মাণকাজ শেষ হলে তা হবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নাইট সাফারি পার্ক।
২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর মৌজার ৪০ একর জমিতে গড়ে তোলা হবে এই ‘নাইট সাফারি পার্ক’।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বলেন, ‘বন্যপ্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশ, খাদ্যচক্র ও জীববৈচিত্র্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাহাড় ও বন ধ্বংস করে অবৈধ আবাসন ও জবরদখলের কারণে জঙ্গল সলিমপুরের বনের অস্তিত্ব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।’
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ইকো ট্যুরিজমের উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, শিক্ষা, গবেষণা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নাইট সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
‘জঙ্গল সলিমপুর মৌজার প্রায় ৮৫০ একর সরকারি জায়গা দীর্ঘদিন ধরে বেদখল হয়ে আছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সেখানকার ৪০ একর জমিতে নাইট সাফারি পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এ পার্কটি সিঙ্গাপুরের মান্দাইতে অবস্থিত পার্কের আদলে গড়ে তোলা হবে। প্রাথমিকভাবে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা চিড়িয়াখানার নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হবে’, বলেন জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান।
নাইট সাফারি পার্কের নকশা প্রণয়নের জন্য মঙ্গলবার প্রকৌশলীদের একটি দল সাইট এলাকা ভিজিট করেছেন। জেলা প্রশাসক জানিয়েছে আগামী এক মাসের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ তারা নাইট সাফারি পার্ক চালুর আশা করছেন।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, ‘চট্টগ্রামে যে সাফারি পার্কটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেখানে বন্যপ্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশে পুরোপুরি উন্মুক্ত অবস্থায় থাকবে। খাঁচার সংখ্যা কমিয়ে সেখানে আচরণে মিলে আছে এমন প্রাণীদের একসঙ্গে রাখা হবে। দর্শনার্থীরা গাড়ি দিয়ে খাঁচার ভেতর প্রবেশ করবেন।’
‘এ সাফারি পার্কে সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে আলাদা শোয়ের ব্যবস্থা থাকবে। ভেতরে এমনভাবে আলো-আঁধারী পরিবেশ তৈরী করা হবে, যাতে দর্শকরা বন্যপ্রাণী রাতের বেলা কিভাবে চলাচল করে বা খাবার খায় তা সরাসরি দেখতে পাবেন’, বলেন ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ।
সাফারি পার্কটি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ইউনিট-২ হিসেবে পরিচালিত হবে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সাফারি পার্কে বিপন্ন এশিয়ান হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি পাহাড়ে পাখির অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হবে। পার্কে বন্যপ্রাণীসমূহ উন্মুক্ত অবস্থায় বনজঙ্গলে বিচরণ করবে এবং মানুষ সতর্কতার সাথে চলমান যানবাহনে চেপে তাদের দেখতে পাবে। প্রতিবছর অন্তত পাঁচ লাখ দর্শনার্থী এই সাফারি পার্কে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন।’
‘সাফারি পার্কে বাঘ, সিংহ, জলহস্তী, জিরাফ, উট, ক্যাঙ্গারু, লামাসহ বিভিন্ন প্রজাতির আরও পশুপাখি সংগ্রহ করে বংশবৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা হবে। এখানে গবেষণার মাধ্যমে প্রাণি সংরক্ষণে ভূমিকা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে’, বলেন মো. মমিনুর রহমান।
তবে দেশের পরিবেশকর্মীসহ অনেকেই এই সাফারি পার্কের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বন ও পাহাড় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
পরিবেশকর্মী আ ন ম মোয়াজ্জেম হোসেন রিয়াদ বলেন, ‘বস্তুত চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কের মধ্যে কোনো তফাত নেই। আমরা দেশের সাফারি পার্কগুলো থেকে প্রায়ই বন্যপ্রাণীদের করুণ মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। ছোট্ট এই দেশে কয়টি সাফারি পার্ক প্রয়োজন? কেন্দ্রের অনুমতি থাকার পরেও সম্প্রতি তামিলনাড়ু সরকার নাইট সাফারি পার্ক স্থাপনের কাজ বাতিল করেছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামান বলেন, ‘প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য ও সুপেয় পানির প্রাকৃতিক আঁধার হিসেবে কাজ করে পাহাড়। সেই পাহাড়ে কেন সাফারি পার্ক করতে হবে তা আমার বোধগম্য নয়। এই স্থাপনাগুলোকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া নগরায়ন জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলবে।’
তবে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভর দাবি সাফারি পার্কটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় প্রতিবছর প্রাণীর সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি রয়েল বেঙ্গল টাইগার চারটি বিরল সাদা বাঘশাবকের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে বাঘের সংখ্যা ১৬। অস্তিত্বের সংকটে থাকা বাঘকে বাঁচাতে সাফারি পার্কে টাইগার ব্রিডিং সেন্টার করা হবে। এছাড়া হরিণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ত্রিশে, সাফারি পার্ক ব্যবহার করে হরিণের সংখ্যা ১০০-১৫০ তে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এছাড়া বান্দরবানের কাসালাং রেঞ্জে সরকারের বাঘ ছাড়ার যে পরিকল্পনা, সেটা কার্যকর করতে সাফারি পার্ককে আমরা গবেষণার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবো।’