এম.এইচ মুরাদঃ
তারামন বিবির সংসারে পাঁচ ছেলে মেয়ে। স্বামীর সাথে পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে সংসার পেতেছেন সেই ১৯৭৮ সালে। বাঁশের বেড়া আর টিনের ছাউনির দুই কামরার ছোট্ট খুপড়ি ঘর। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতেই দিন কাটছিল তার। কিন্তু এরমধ্যে একদিন নোটিস আসে বসত ভিটা ছাড়তে হবে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। দুই ছেলে রিকশা চালায় আর বছর তিনেক ধরে স্বামী কর্ম অক্ষম। কিন্তু নিয়তি তাকে খোলা আকাশের নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গতকাল সকালে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তারামন বিবি বলছিলেন, ৩৩ বছর ধরে জেনে আসছি, এটি আমার স্বামীর ঘর। কিন্তু এত বছর পর সরকার বলছে আমরা অবৈধভাবে বসবাস করছি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও আজ আমরা পরাধীন। অথচ এখানে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার নতুন নতুন ঘর তৈরি করে পুনর্বাসন করছে, আর আমরা স্বামীর ভিটা হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছি। এখন আমরা কোথায় যাবো, কি করবো কিছুই জানি না।
ঘরের টিনের ছাউনি খুলে এক জায়গায় জড়ো করছিলেন ইসমাইল আলী। অথচ সাধের ঘরটি তৈরি করেছিলেন মাত্র ছয় মাস আগে। কখনো ভাবেননি, এভাবে একে একে সবকিছু নিজ হাতে খুলে নিতে হবে। মনে চাপা কষ্ট ও ক্ষোভ নিয়ে ছাড়ছিলেন মাথা গোঁজার জায়গাটি। জানতে চাইলে রাগ আর সংবরণ করতে পারেন নি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘এই দ্যাশত রোহিঙ্গা অল জামাই আদর পায়, আর আঁরা উদ্বাস্তু অই গেই, আঁরা রোহিঙ্গা অলত্তুনও হারাপ’ অর্থাৎ এই দেশে রোহিঙ্গারা জামাই আদর পাচ্ছে, আর আমরা উদ্বাস্তু হয়ে গেছি, এখন আমরা রোহিঙ্গাদের থেকেও খারাপ হয়ে গেছি। পরবর্তী গন্তব্য কোথায় জানতে চাইলে ইসমাইল আলী বলেন, একটি গার্মেন্টসের ফিনিশিং সেকশনে চাকরি করি। নিয়মিত বেতন নাই, কোনো মতে ধার দেনা করে চলতে হচ্ছিলো। এত বছর ঘর ভাড়া দিতে হতো না, এখন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। সরকারের কাছে একটাই দাবি, আমাদের তালিকা করে যেন পুনর্বাসন করা হয়।
একই কথা বলছিলেন লালদিয়া চরের বাসিন্দা শাহ আলম। তিনি বলেন, ঋণ নিয়ে গত বছর একটি সেমি পাকা ঘর করেছি, আজ সেটি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। নিজের হাতে গড়া ঘরটি আজ নিজের হাতেই ভাঙতে হচ্ছে। মাথার ওপর খোলা আকাশ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বলতে বলতেই গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো তার। লালদিয়ার চরের প্রায় সব বাসিন্দাকে ৪৮ বছরের বাপ দাদার বসত ভিটা ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে হচ্ছে। এই লালদিয়া চরে ২ হাজার ৩০০টি পরিবারের প্রায় ১৪ হাজার মানুষের বসবাস। বাড়ি ভিটে হারানোর বেদনায় শোকার্ত সবাই। প্রিয়জন হারানোর মতোই বিলাপ করে কাঁদছেন মোহছেনা আকতার। চোখ মুছতেই মুছতে বলছিলেন, এই চরে ৪০ বছর ধরে বসবাস করছি। কিন্তু সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। লালদিয়া চরের প্রত্যেক বাসিন্দার চোখের পানি এখন যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। এখানের কারও ভবিষ্যৎ এখন নিশ্চিত নয়। কে কোথায় যাচ্ছে বা যাবে তা কেউ বলতে পারবে না। আমি চাই সরকার আমাদের অন্তত ছোট্ট একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিক যাতে আমরা রোদ বৃষ্টি থেকে হলেও একটু রক্ষা পাই।
উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীর তীর সংলগ্ন পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে চূড়ান্ত উচ্ছেদের বিষয়টি বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বৈঠক করে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও লালদিয়ার চর পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটিকে জানিয়ে দেয়। উচ্চ আদালতের উচ্ছেদের নির্দেশনার সাথে সহমত পোষণ করে চরের বাসিন্দারা নিজ দায়িত্বে ঘর বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের পরবর্তী গন্তব্য কোথায় অনেকে তা জানেন না। তারা চায় সরকার তাদেরকে পূনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে একটি নিরাপদ ভবিষ্যত দান করুক এবং দেশের অন্যসব মানুষের মতো রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারে মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।