স্টাফ রিপোর্টারঃ
করোনা সংক্রমণের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকার লকডাউন ঘোষণা করার মাধ্যমে সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে লক করা গেলেও লক করা যায়নি এনজিওভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউসেপ স্কুলকে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে সশরীরে স্কুলে হাজির করে নেওয়া হচ্ছে অর্ধবাষিক পরীক্ষা। সরেজমিনে পরিদর্শনকালে এ চিত্র দেখা গেছে।
পরীক্ষা গ্রহণকালে এক সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে ছাত্র-ছাত্রী রেখেই সটকে পড়েন স্বয়ং প্রধান শিক্ষক ও পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা।
সোমবার (২৮ জুন) দুপুর সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানাধীন পাহাড়তলী বাজার স্টেশন কলোনি ইউসেপ স্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা নিতে দেখা যায়। এ সময় আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা দ্রুত খাতা জমা দিয়ে দেয়। পরে তাদের বাসায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, জোর পূর্বক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে টিউশন ফি বাবদ ১ হাজার টাকা আদায় করার জন্যই চুপিসারে পরীক্ষা গ্রহণের আয়োজন করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ১০ম শ্রেণীর ছাত্র মেহেদী হাসান (বিজ্ঞান বিভাগ, রোল ২২) ও তাসলিমা আক্তার (বাণিজ্য বিভাগ, রোল ২) এর কাছে জানতে চাওয়া হয় সরকারি নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানে কি না। উত্তরে ‘হ্যাঁ সূচক’ জবাব দিয়ে তাদের পরীক্ষায় বাধ্য করার কথা জানান। আর এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন।
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার সময় শিক্ষক শাহ আলমসহ আরও ২জন শিক্ষক সটকে পড়েন। প্রধান শিক্ষক শাহনেওয়াজকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কারণ জানতে চাইলে তিনি দোষ স্বীকার করে বারবার ক্ষমা চাইতে থাকেন। এবং তার কাছে বড় বড় সাংবাদিক পরিচয় আছে বলে নিউজ না করতে হুশিয়ারি প্রদান করেন।
অপরদিকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন অভিবাবকরা। তারা বলছেন এরকম একটি পরিস্থিতিতে কিভাবে একজন শিক্ষক কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয়ে জড়ো করে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারেন তা আমরা বুঝতে পারছিনা। এখন যদি আমাদের বাচ্চার কিছু হয় তার দায়-দায়িত্ব কি বিদ্যালয় কতৃপক্ষ নিবে? আমরা সরকারের কাছে এই ঘটনার সাথে জড়িত সবার বিচার দাবী করছি। তারা শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ও সুস্থতার কথা চিন্তা না করে শুধুমাত্র টাকা আদায় করার জন্য কৌশলে শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়ে ডেকে নিয়েছেন বলেও দাবী করেন।
জানা যায়, ইউসেপ স্কুল পাহাড়তলী স্টেশন সংলগ্ন শাখার শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে ইচ্ছেমতো টিউশন ফি আদায় করছে। ৮ম শ্রেণীর রেজিস্ট্রেশন ফি ১ হাজার টাকা ও দশম শ্রেণীর ২ হাজার টাকা করে রেজিস্ট্রেশন ফি নেয়া হচ্ছে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হলেও তাতে উচ্চ হারে ফি আদায়ে বাধ্য করায় অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করা হয়েছে।
টিউশন ফি না দেয়ায় আকবরশাহ রেলহাউজিং এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আক্তারের (৪০) ৮ম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েকে পড়া লেখায় ইতি টানতে হয় বলে সূত্রে জানা যায়। অথচ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহনেওয়াজ জানান, স্কুলটিতে ৫ম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত অনুদানের টাকায় চলে।
চট্টগ্রামে এনজিও পরিচালিত ইউসেপ স্কুল রয়েছে ১২টি। পাহাড়তলী বাজার স্টেশনের পাশে ২তলা বিশিষ্ট স্কুলটিতে ৪৯৫ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। শিক্ষক রয়েছেন ১০জন। শিক্ষক সোলায়মান জানান, ৮ম শ্রেণীতে ৩০ জন, ৯ম শ্রেণীতে ৫২ জন, দশম শ্রেণীতে ৬২জন ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করছে। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষা অন্য বিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রেশনের মাধ্যমে দিয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
ইউসেপ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহনেওয়াজ জানান, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সরকারি অনুমোদন না থাকায় ঝাউতলা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে এসএসসি ও সরাইপাড়া ইডেন স্কুলের মাধ্যমে জেএসসি রেজিস্ট্রেশন করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে চুক্তিভিত্তিতে।
রেজিস্ট্রেশন ফি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২ হাজার টাকা কেন আদায় করলেন— জানতে চাইলে প্রথমে অস্বীকার করেন। পরে প্রমাণ দেখানো হলে স্বীকার করেন এসএসসি রেজিস্ট্রেশন ফি জনপ্রতি ১৮৫০ টাকা নেয়া হয়। করোনার এই দুর্যোগে টিউশন ফি আদায়ের জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মৃত্যু ঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া কতটা মানবিক? জানতে চাইলে উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন প্রধান শিক্ষক।
চট্টগ্রাম ইউসেপ স্কুলের রিজিওনাল ম্যানেজার জয় প্রকাশ বড়ুয়ার কাছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,’ আমি শুনেছি এরকম একটা ঘটনা হয়েছে আমাদের ঐ বিদ্যালয়টিতে। বর্তমান মহামারীর এই পরিস্থিতিতে ছোট ছোট বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে এনে পরীক্ষা বা এসাইনমেন্ট নেয়াটা সমুচিত হয়নি। আমাদের নির্দেশনা ছিলো এসাইনমেন্টের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের ডেকে তা বুঝিয়ে দেওয়া কিন্তু তা না করে সবাইকে জড়ো করে এরকম একটা ঘটনা আসলেই অনাকাঙ্ক্ষিত বলে আমি মনে করছি। আমরা এ ব্যাপারে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করবো। আপনি দায় এড়াতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো বলছি এটি অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা। যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ গঠন করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। অবশ্য তিনি পরে বলেছেন এভাবে জড়ো করে পরীক্ষা ও এসাইনমেন্ট নেয়ার বিষয়ে ওনি শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলাপ করেছেন।
তবে করোনা সংক্রমণের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম ইউসেপ স্কুলের রিজিওনাল ম্যানেজার জয় প্রকাশ বড়ুয়ার এমন বক্তব্য কতটুকু যুক্তিক ও সত্য তা সংশ্লিষ্ট উপমন্ত্রী, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে প্রতীয়মান হবে বলে করছেন শিশু ও মানবাধিকার সংগঠন কর্মী আকবর চৌধুরী। তিনি মনে করেন যেখানে সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউনসহ সমস্ত স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে সেখানে সরকারের কর্তাব্যক্তিরাই আবার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ডেকে পরীক্ষা বা এসাইনমেন্ট নিতে বলা কোনভাবে যুক্তিসংগত নয়। আর ওনারা এরকম এরকম নির্দেশনা দিবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। হয়তোবা ইউসেপ কতৃপক্ষ এই অভিযোগ থেকে বাঁচতে এরকম তথ্য প্রচার করছে।
বি:দ্রঃ সময়ের সল্পতা ও করোনা পরিস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়ে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তী প্রতিবেদনে এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য সহকারে আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে…