স্টাফ রিপোর্টারঃ
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিবর্তে এখন পতেঙ্গা-সাগরে রাম-রাজত্ব কায়েম করে চলেছে স্থানীয় ইলিয়াছ-আক্কাস সিন্ডিকেট। এদের হাতে নিয়মিত নিগৃহীত হচ্ছে জেলেরা। চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে ট্রলার মালিকরাও। সাগরে নিরাপদে মাছ ধরতে হলে এদের কাছ থেকে নিতে হয় লাইসেন্স। কারণ তারা পতেঙ্গা বঙ্গোপসাগরকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে নির্ধারিত সীমান্তে চালাচ্ছে রামরাজত্ব।
স্থানীয়রা জানান, সরকারের নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ধরতে চট্টগ্রামের সামুদ্রিক এলাকা বিক্রি করে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পতেঙ্গার স্থানীয় সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট বিভিন্ন জেলার জেলেদের কাছে সমুদ্রপাড়ও বিক্রি করছে। স্থানভেদে জেলেদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। গত দুই সপ্তাহে প্রায় ৩০০ বহিরাগত বোটের কাছে এই পাড় বিক্রি করেছে ১৫ নম্বর মুসলিমাবাদের ইলিয়াছ সওদাগর—প্রকাশ গাভী ইলিয়াছ ও আকমল আলী এলাকার আক্কাস সওদাগর সিন্ডিকেট। প্রকাশ্যে এসব বোট থেকে প্রতিদিন টন টন জাটকা নিধন করা হচ্ছে যা দণ্ডনীয় অপরাধ।
সরেজমিনে চট্টগ্রামের ইপিজেড থানার আকমল আলী, খেজুরতলা ও পতেঙ্গার মুসলিমাবাদ এবং বন্দর থানার কাট্টলী এলাকায় গিয়ে এসব চিত্র দেখা গেছে। বঙ্গোপসাগর ঘিরে জলদস্যু সিন্ডিকেটের এমন অরাজকতা চললেও প্রশাসন এক্ষেত্রে নিরব ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে। ‘সাগর উত্তাল’—এমন অজুহাত দেখিয়ে ‘অভিযান পরিচালনার সুযোগ নেই’ বলে দায় এড়াচ্ছেন প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আছে আরও ১০ দিন। তার আগেই সাগরজুড়ে দেখা যাচ্ছে শত শত ফিশিংবোট। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইতোমধ্যেই এসব ফিশিংবোট সাগরে মাছ ধরা শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রায় তিন শতাধিক ফিশিংবোট জাটকা ইলিশ মাছ নিধনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী এবং হাতিয়া জেলা থেকে শত শত ভাসান জালের বোট এসেছে পতেঙ্গার ১৫ নম্বর, মুসলিমাবাদ ও ইপিজেডের খেজুরতলা, আকমল আলী এবং কাট্টলী এলাকায়। প্রতিটি বোট থেকে আদায় করা হচ্ছে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা। এই টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে ওই এলাকার সাগরে মাছ ধরার অনুমতি—লাইসেন্স।
জানা গেছে, পতেঙ্গায় ইলিয়াছ—আক্কাস সিন্ডিকেটের লোকজন এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। জেলেরা লাইসেন্স না নিলে সাগরে ট্রলার ডাকাতি, মাঝিমাল্লা অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়সহ নানাভাবে জেলেদের হয়রানি করেন তারা। এমনকি জেলেদের গুলি করে খুনও করা হয়। গত এক বছরে বঙ্গোপসাগরে ৬৩ মাঝিমাল্লাসহ ২১ ফিশিংবোট অপহরণ হয়েছে। পরে ১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরতে হয়েছিল ৬৩ মাঝিমাল্লাকে। এছাড়া গত ৫ বছরে জলদস্যু বাহিনীর হাতে ২ শতাধিক মাঝি-মাল্লা প্রাণ হারিয়েছে।
স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, সাগরে মাছ ধরার সময় এখনও ১০ দিন বাকি রয়েছে। এখনও জাল বোনা শেষ হয়নি পতেঙ্গা এলাকার অধিকাংশ স্থানীয় জেলের। অথচ বহিরাগত জেলেরা এই এলাকায় এসেই সাগর দখল করে ইলিশ মাছ ধরা শুরু করে দিয়েছে। পতেঙ্গা মুসলিমবাদ ও ইপিজেড খেজুরতলা ও আকমল আলী সাগরপাড় এবং কাট্টলী এলাকায় প্রায় তিন শতাধিক ভাসান জালের বোট থেকে প্রতিদিন জাটকা মাছ নিধন করা হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করছে।
তারা আরো জানান ইলিয়াছ-আক্কাস পতেঙ্গার চিহ্নিত চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট তারা পতেঙ্গা ১৫ নম্বর, মুসলিমবাদ, খেজুরতলা ও আকমল আলী, কাট্টলী এলাকায় সাগরের পাড় বেচাকেনা করে। এভাবে প্রতিবছরই কয়েক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেন তারা। বহিরাগতদের বোটের ভিড়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে এবারও অনিশ্চিয়তায় মুখে পড়েছেন স্থানীয় জেলেরা।
এ বিষয়ে জানার জন্য ইলিয়াছ-আক্কাসের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে, সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর সংযোগ বিছিন্ন করে দেন।
জানা যায়, মাছের প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে উপকূলীয় ১৪টি জেলার ৬৬টি উপজেলায় ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯৫টি জেলে পরিবারকে ১৬ হাজার ৭২১.৩২ মেট্রিক টন ভিজিএফের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০ এর ধারা-৩ এর উপধারা-২ এর ক্ষমতাবলে চলতি বছরে ১৩ এপ্রিল এ নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, গত এক সপ্তাহে দুইবার অভিযান পরিচালনা করেছি কাট্টলী এলাকায়। কিন্তু এখন সাগর উত্তাল। জেলেরা যেখানে মাছ ধরতে যায়, সেখানে আমাদের যাওয়া একটু কঠিন। শনিবার (১০ জুলাই) অভিযান চালিয়ে বোট ফেলে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের কাউকে আটক করা যায়নি। এ সময় আমরা ২২ টন জাটকা ইলিশ মাছ জব্দ করেছি। পরে এগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদরঘাট থানার নৌ-পুলিশের পরিদর্শক (ওসি) এবিএম মিজানুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে সাগরের যে আবহাওয়া সেখানে আমাদের স্পিডবোট দিয়ে যাওয়া অনেক সময় কঠিন। আমাদের স্পিড বোট দিয়ে মোহনা পর্যন্ত যাওয়া যায়। এই আবহাওয়ায় অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা আছে শুধু কোস্টগার্ডের। তবু আমি দেখছি কিভাবে অভিযান পরিচালনা করা যায়।