মোরশেদুল হক আকবরীঃ
অবশেষে শেষ হলো বহুল আলোচিত চট্টগ্রামের পটিয়ার কালারপোল সেতুর নির্মাণ কাজ। পরপর তিন দফা মেয়াদ বাড়ানোসহ এক যুগেরও বেশি সময় নিয়ে পটিয়ার কালারপোল সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। এই একটি সেতুর জন্য ১৪ বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে দুই উপজেলা পটিয়া ও আনোয়ারা কর্ণফুলীর কয়েক লাখ মানুষকে। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে বিলম্ব হয়েছে সেতুর নির্মাণকাজের মেয়াদকাল। ফলে নানা দুর্ভোগ সঙ্গী করে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে বা নৌকা দিয়ে পারাপার করছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ এই এলাকার সাধারণ মানুষ। এতে পশ্চিম পটিয়ার চাঁপড়া, মোহাম্মদনগর, কোলাগাঁও, মুন্সিরহাট, লাখেরা, চরকানাই, হুলাইন, পাঁচুরিয়াসহ আশপাশের এলাকার জনসাধারণের দুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে।
সওজ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৮ নভেম্বর সেতুটি ভেঙে যাওয়ার পর নতুনভাবে সেতু নির্মাণের জন্য প্রথমবার ২২ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় সেতু মন্ত্রণালয়। সংশ্নিষ্ট ঠিকাদার কিছুদিন কাজ করে। একসময় কাজ চলাকালীন কাজ বন্ধ করে চলে যায়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় মেয়াদে সেতুর জন্য ২০১৭ সালে এটি ২৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা নতুনভাবে বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর নামে সেতুটির নামকরণ হয়। এটির নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কালারপোল সেতু ১৯৯৫ সালে নির্মিত হয়। ২০০৭ সালের ১৮ নভেম্বর একটি কারখানার টিনের কয়েল বোঝাই বার্জের আঘাতে সেতুর ৩য় ও ৪র্থ স্প্যান নদীতে নিমজ্জিত হয়। সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন হওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরোনো স্প্যানটির ওপর সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য একটি বেইলি ব্রিজ তৈরি করে দেয়। অবশ্য বেইলি ব্রিজটিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
দ্বিতীয় দফায়ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বছর দুয়েক সেতুর কাজ করার পর লোকসান দেখিয়ে কাজ ফেলে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সেতু মন্ত্রণালয়। দুই বছর আগে নতুনভাবে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়রা জানান, খাল পারাপারে সেতুটি একমাত্র ভরসা হওয়ায় ওই পথে যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। কালারপোল লাখেরা উচ্চ বিদ্যালয়, কালারপোল হাজি ওমরা মিয়া চৌধুরী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, কালারপোল অহিদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, এ জে চৌধুরী স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করে। এ ছাড়া সেতুর উভয় পাশে গড়ে ওঠেছে কয়েকটি শিল্প-কারখানা, লবণ কারখানা, শতাধিক পোলট্রি ও ডেইরি ফার্ম। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের খাল পারাপারে কষ্টের সীমা নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা জানে আলম জনি বলেন, ‘প্রায় সময়ই বন্ধ থাকতো সেতুর নির্মাণকাজ। মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে সেতুর নির্মাণকাজ সঠিক সময়ে শেষ হয়নি। প্রতিনিয়ত নদী পারাপারে দুর্ভোগে পড়তে হয় আমাদের। এখন সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে, তাই দ্রুত উদ্ভোধন করে যান চলাচলের ব্যবস্থা করলে দুই উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ উপকৃত হবে।’
আবদুল মজিদ ওরফে কালা মাঝি বলেন, ‘ঠিকাদারের অধীনে একটি নৌকা দিয়ে কয়েক বছর ধরে জনসাধারণকে বিনামূল্যে খাল পারাপার করেছি। আমাদের বেতন ও নৌকা ভাড়া ঠিকাদার দিয়েছেন। এখন সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তাই মানুষ সেতুর উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে পারাপার হচ্ছে। সেতু উদ্ভোধনের পর যান চলাচল করলে অত্র এলাকার কয়েক লাখ মানুষ উপকৃত হবে।’
এ প্রসঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাকির এন্টারপ্রাইজের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান টিটু বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ, করোনা আসাতে লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ফলে নির্মাণকাজ ধীর গতিতে হয়। ফলে আমাদের সেতুর কাজ শেষ করতে বিলম্ব হয়েছে। এখন পুরোপুরি সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে উদ্ভোধনের মাধ্যমে এই সেতু জনসাধারণ ও যানচলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।’
এ প্রসঙ্গে দোহাজারী সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ বলেন, ‘কালারপোল সেতু নির্মাণে দীর্ঘ সময় লাগার পিছনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কিছুটা গাফিলতি ছিলো বলে মনে করি। আমরা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তাদের লিখিতভাবে বিষয়টি বলেছি। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সবার সহযোগিতায় এই সেতুর নির্মাণ কাজ আমরা শেষ করতে পেরেছি। এখন উদ্ভোধনের মাধ্যমে এই সেতু জনসাধারণ ও যানচলাচলের জন্য উমুক্ত করা হবে। এর ফলে এই এলাকার লাখো মানুষের অনেক দিনের সপ্ন পূরন হবে এবং তাদের চলাচলের ভোগান্তি লাগব হবে বলে আমি মনে করি।’