স্টাফ রিপোর্টারঃ
চট্টগ্রামের এক সময়ের জাহাজ ভাঙা শিল্পের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ‘রাইজিং গ্রুপ’। বিএনপির কারাবন্দি কেন্দ্রিয় নেতা আসলাম চৌধুরীর মালিকাধীন গ্রুপটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স সুজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ১৭০ কোটি টাকার মামলা করেছে বেসিক ব্যাংক। এতে করে রাইজিং গ্রুপের কাছে পাওনা ১৯ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ালো প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এই পাওনা আদায়ে গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মামলা দায়ের করা হয়েছে ৩০টি।
গ্রুপটির কর্ণধার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি। সেই সঙ্গে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিপুল এই পাওনা আদায়। নামে রাইজিং গ্রুপ হলেও দেনার দায়ে ডুবন্ত তরী হিসেবেই ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে আসলাম চৌধুরীর মালিকনাধীন এ শিল্প গ্রুপটি।
আদালতের তথ্যমতে, কনফিডেন্স সুজ লিমিটেডের কাছে ১৭০ কোটি টাকা পাওনা আদায়ে বেসিক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়েছে। এতে কনফিডেন্স সুজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও আসলাম চৌধুরীর স্ত্রী জামিলা নাজনীল মাওলা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আসলাম চৌধুরীর ভাই মো. আমজাদ হোসেন চৌধুরী ও মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী, আমজাদ চৌধুরীর স্ত্রী ইসমত জাহান এবং শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরীকে বিবাদী করা হয়েছে।
ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কারখানার কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিতে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয় কনফিডেন্স সুজ। এক বছর গ্রেস পিরিয়ডের পর নির্দিষ্ট কিস্তিতে ওই ঋণ শোধের কথা থাকলেও টাকা দেননি প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিশেষ ব্যবস্থায় ২০১৭ ও ২০১৯ সালে ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেও ডাউন পেমেন্ট পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে কনফিডেন্স সুজের কাছে বেসিক ব্যাংকের সুদাসলে পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৭০ কোটি ৩৮ লাখ ৭৪ হাজার ৬১২ টাকা। রাইজিং গ্রুপের অন্য একটি প্রতিষ্ঠান সেভেন বি এসোসিয়েটসের কাছেও ১৯২ কোটি ৪৮ লাখ ৩৫ হাজার ৫০৭ টাকা পাওনা রয়েছে ব্যাংকটির। এই পাওনা আদায়েও ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর অর্থঋণ মামলা দায়ের করে বেসিক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা।
বেসিক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও ব্রাঞ্চ ইনচার্জ ফয়সাল শাহ কোরেশি বলেন, ‘বহু চেষ্টার পরও ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়েছে। ১৭০ কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে ব্যাংকের কাছে মাত্র ৪২২ শতক জমি বন্ধক, যার মূল্য ঋণের তুলনায় খুবই কম।’
এ বিষয়ে জানতে কনফিডেন্স সুজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন চৌধুরীর ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার কল করেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
আদালত ও পাওনাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, রাইজিং গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পাওনা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এসব পাওনা আদায়ে এ পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি মামলা হয়েছে কর্ণধারদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আসলাম চৌধুরী, ভাই আমজাদ হোসেন চৌধুরী, জসিম উদ্দিন চৌধুরী, আসলামের স্ত্রী জামিলা নাজনীল মাওলা ও আমজাদের স্ত্রী ইসমত জাহান বিবাদী।
রাইজিং গ্রুপের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী নাসিমা আক্তার চৌধুরী অবশ্য বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আসলাম চৌধুরীসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগিতার কারণে একটি উদীয়মান শিল্প গ্রুপের আজ এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।’
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা মামলায় আসলাম চৌধুরীসহ চারজনই ইতোমধ্যে কয়েকদফা হাইকোর্ট থেকে জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছেন বলেও উল্লেখ করেন এই আইনজীবী।
রাইজিং গ্রুপের মূল কর্ণধার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। যিনি গত ৫ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। এরপর থেকে ব্যবসা পরিচালনা করছেন তার ভাই মো. আমজাদ হোসেন চৌধুরী।
তবে ২০১৩ সালের পর থেকে রাইজিং গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক খেলাপি হতে শুরু করে। ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলো এনআই অ্যাক্ট ও অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে। এরপর ২০১৫ সালের মধ্যে রাইজিং গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ সুবিধা বন্ধ হওয়ার পর স্বজনদের নামে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন আমজাদ চৌধুরী। পরিবারের বাইরে ভাগ্নে সরওয়ার হোসেন, ভাগ্নিজামাই মিনহাজুল হাসান এবং নিজের শ্যালক শহীদুল হককে দিয়ে তিন ব্যাংক থেকে ম্যাস শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে নেন ২৫০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা।
ম্যাস শিপ ব্রেকিং ২০১৫ সালে ফারমার্স ব্যাংক (সাবেক পদ্মা ব্যাংক) খাতুনগঞ্জ থেকে ১১৫ কোটি, ২০১৪ সালে এবি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ১১২ কোটি টাকা ও আইএফআইসি ব্যাংক অলংকার মোড় থেকে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়। পুরোনো জাহাজ আমদানি করতে এ ঋণ সুবিধা নিলেও মূলত সেই ঋণ ব্যবহার করেছেন আমজাদ চৌধুরী। ফলে দীর্ঘ সময়েও ঋণের টাকা শোধ করতে পারেননি ম্যাস শিপ ব্রেকিংয়ের কর্ণধাররা।
এছাড়াও বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী ও আমজাদ চৌধুরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাইজিং গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এবি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৪৬৫ কোটি টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক হালিশহর শাখার ১৫৮ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পাহাড়তলী শাখার ১৫৩ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১০৫ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক ভাটিয়ারি শাখার ৮২ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংকের সিডিএ করপোরেট শাখার ৭৪ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৭৩ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৬৯ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এন্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটিডের ৫০ কোটি টাকা, লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সের ৪০ কোটি টাকা, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ২৩ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক সিডিএ শাখার ২১কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ২০ কোটি টাকা, আইআইডিএফসির ১৯ কোটি টাকা, আইডিএলসির ১৯ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ভাটিয়ারি শাখার ৯ কোটি টাকা পাওনা।
আদালতের তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পরিশোধ বা সেটেলমেন্ট করার শর্তে ২০১৮ থেকে বিভিন্ন সময় হাইকোর্ট থেকে জামিন পান প্রতিষ্ঠানটির চার কর্ণধার। তবে ব্যাংকগুলো বলেছে, এখন পর্যন্ত তারা এক টাকাও পরিশোধ করেননি। এমনকি কোনো সেটেলমেন্টও হয়নি।
এদিকে এবি ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আসলাম চৌধুরী, তার স্ত্রী জামিলা নাজনিন মাওলা, ভাই আমজাদ হোসেন ও মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের শেষ দিকে পৃথক দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রামের কার্যালয়। ওই দুই মামলাতেই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনোটির বিচার শুরু হয়নি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট সানোয়ার আহমেদ লাভলু বলেন, ‘ছয় মাসের মধ্যে পাওনাদার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে সেটেলেমেন্টে যাওয়ার শর্তে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছিলেন এই খেলাপীরা। এছাড়াও পাসপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু জামিন পাওয়ার দুই বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংকে ঋণ সেটেলমেন্ট করেননি প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা। এমনকি জামিন নেওয়ার পর থেকে তিনজনই গা ঢাকা দিয়েছেন।’
চট্টগ্রামের এক সময়ের আলোচিত ব্যবসায়ী প্রাতিষ্ঠান রাইজিং গ্রুপ ও সেভেন-বি অ্যাসোসিয়েট। এই দুই প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা ছিল পুরান জাহাজ আমদানির পর ভেঙে ইস্পাত বানানো। অথচ ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর উপস্থাপন করা খেলাপি ঋণের তালিকায় ১৯ নম্বরে রয়েছে রাইজিং গ্রুপ ও ৩৭ নম্বরে সেভেন-বি অ্যাসোসিয়েট।