স্টাফ রিপোর্টারঃ
বিশ্বকাপে চুমু দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলেন না লিওনেল মেসি। ছবি: ফিফা
শেষ পর্যন্ত মেসির হাতেই বিশ্বকাপ। অপেক্ষাটা ছিলো দীর্ঘদিনের। ২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত মাঠে আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠে নামেন মেসি। গোলও করেন একটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশি দূর যাওয়া হয়নি আর্জেন্টিনার। ২০১০ আফ্রিকা বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মেসিকে সঙ্গ দেয়ার মত খেলোয়াড় ছিলো না দলে। ফলে আবারও স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই বিদায়। ২০১৪ বিশ্বকাপে দুর্দান্তভাবে ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়া আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত ১-০ ব্যবধানে হেরে যায় জার্মানের কাছে। স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখা মাত্র। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপও ছিলো আর্জেন্টিনার হয়ে হতাশার গল্প। অবশেষে সফলতা এলো। কিন্তু অনেক কষ্টে অর্জিত হয়েছে সেই সফলতা।
কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার থেকেও ফেভারিট হিসেবে মাঠে নামে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। সেই সঙ্গে শিরোপার লড়াইয়ে সবচাইতে বেশি শোনা গিয়েছে ইংল্যান্ড ও স্পেনের নাম। লাতিন রাইভাল ব্রাজিলও ছিলো এবারের বিশ্বকাপের ফেভারিট। ফিফা র্যাংকিংয়ে শীর্ষ স্থানে থেকে দলটি বিশ্বকাপ আসর শুরু করে। অন্যদিকে গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে হার দিয়ে শুরু হয় আর্জেন্টিনার। আর সেটাও র্যাংকিংয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হেরে। এই ম্যাচে আরও একবার সমালোচনা হয় আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ নিয়ে।
কিন্তু এখানেই শেষ। এরপর একের পর এক চমক দেখায় আর্জেন্টিনা। প্রতিটি ম্যাচেই ছিলো ভিন্ন পরিকল্পনা, ভিন্নভাবে ম্যাচ শুরু করা। যার বড় কৃতিত্ব দলটির কোচ লিওনেল স্কালোনির। নক আউট পর্বে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ২-১ গোলের জয়, কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি শ্যুটে নেদারল্যান্ডকে হারানো এবং সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করে দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফাইনালে আসে আর্জেন্টিনা। ম্যাচের প্রথমার্ধ জুড়ে সেই তীব্র আত্মবিশ্বাস ছিলো আর্জেন্টিনার চোখে মুখে। ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনা কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায় যখন ডি মারিয়াকে তুলে নেয়া হয় মাঠ থেকে। এর আগে ডি মারিয়াকে ফাউল করলে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। ২৩ মিনিটে পেনাল্টি শ্যুট থেকে গোল করে ব্যবধান গড়ে দেন মেসি। এরপর ডি মারিয়ার একক প্রচেষ্টায় লং শট থেকে বল রিসিভ করে গোল। তখন পর্যন্ত ফ্রান্স প্রবেশই করতে পারেনি আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ ভেঙ্গে।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের ৭৫ মিনিট থেকে নতুন রূপে দেখা যায় ফ্রান্সকে। বলের নিয়ন্ত্রণ, ক্ষিপ্রতা, সবকিছুতেই ছাড়িয়ে যায় তারা আর্জেন্টিনাকে। ফল আসে ৮০ মিনিটে। আর্জেন্টিনা নিজেদের ডি বক্সে ফাউল করে বসে ফ্রান্সের কোলো মোয়ানি। ফলে পেনাল্টির ডাক। কোন ভুল না করে গোল করে ব্যবধান কমান এমবাপ্পে। এর ১ মিনিট পরেই কাউন্টারে অ্যাটাকে নিজের দ্বিতীয় গোল করে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান এমবাপ্পে। ৯০ মিনিটে মীমাংসা না হওয়ায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত মিনিটে।
৩০ মিনিটের খেলায় আবারও নিজেদের আসল রূপ দেখায় আর্জেন্টিনা। গোল আসে ১০৮ তম মিনিটে। মার্টিনেজ দুর্দান্ত এক শট নিলে তা ফিরিয়ে দেন গোলকি। কিন্তু সেই বল রিসিভ করে কোন সময় না নিয়ে গোলপোস্টে পাঠিয়ে দেন মেসি। ব্যবধান হয় ৩-১। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ১১৬ মিনিটে ডি বক্সে এমবাপ্পের নেয়া শট থেকে বল লাগে আর্জেন্টিনার মন্টিলের হাতে। পেনাল্টি শট পায় ফ্রান্স। ১৯৬৬ সালে জিওফাস্ট জার্মানির হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাট্রিক করে। কিন্তু সেটা ছিলো বেশ বিতর্কিত। কিন্তু কোন বিতর্ক ছাড়াই বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাট্রিক করলেন এমবাপ্পে। তার পেনাল্টিতে আবারও সমতায় ফেরে ফ্রান্স।
অতিরিক্ত সময়ে খেলার মীমাংসা না হওয়া তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনাল গড়ায় টাইব্রেকারে। আর এখানেই আর্জেন্টিনার হিরো মার্টিনেজ। নেদারল্যান্ডে দুর্দান্ত দুটি সেভ করে রাতারাতি আর্জেন্টিনার ভক্তদের কাছে হিরো বনে যাওয়া এই গোলকিপার ফাইনালেও পেনাল্টি শ্যুটে একটি দুর্দান্ত শট সেভ করেন। আর একটি শট গোলের বদলে বাহিরে করে ফ্রান্স। ব্যস। বাকি ব্যবধান গড়ে দেন আর্জেন্টাইন শ্যুটাররা। একটি শটও মিস না করে ৪-২ ব্যবধানে ১ শট হাতে রেখেই জয় নিশ্চিত হয় আর্জেন্টিনার।
অসংখ্য রেকর্ডে ভরা এবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল। কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের মত আসরে ১০ গোলের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে ৪ গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় হওয়া। এ সব রেকর্ড এখন এমবাপ্পের ঝুড়িতে। সেই সঙ্গে এবারের আসরে ৮ গোল করে গোল্ডেন বুটও তার। কিন্তু তারপরও ম্যাচ শেষে হতাশ এই খেলোয়াড়। কেননা বিশ্বের সবচাইতে আকর্ষণীয় ট্রফি তার হাতছাড়া হয়ে গেছে।
অন্যদিকে পেলের ১২ গোলের রেকর্ড পেনাল্টি শ্যুটে ছাড়িয়ে যাওয়ার পর নিজের দ্বিতীয় গোলে বিশ্বকাপে পেলের সর্বমোট গোলকে ছাড়িয়ে গেলেন লিওনেল মেসি। ১ গোল কম করায় গোল্ডেন বুট না পেলেও গোল্ডেন বলের পুরষ্কার তার হাতে। পুরষ্কার নিতে এসে গোল্ডেন বলের ট্রফি হাতে নিয়ে বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেয়ার ইচ্ছা থামিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। আর তাই হয়ত স্বপ্ন জয়ের স্বাদ গ্রহণ করলেন বিশ্বকাপকে চুমু দিয়ে।