স্টাফ রিপোর্টারঃ
আন্তর্জাতিক বাজারে তিন দিন ধরে বেশ দ্রুত সয়াবিন ও পাম তেলের দাম কমছে। এখন দাম কমে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর আগের দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্য তেল। আন্তর্জাতিক বাজারে এমন সময় দাম কমল, যখন দেশে ভোজ্য তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার তিন শ্রেণিতে ভ্যাট ৩০ শতাংশ কমিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম কবে নাগাদ, কত কমবে—সেই বিষয়টি সামনে এসেছে। এত দিন ব্যবসায়ীদের যুক্তি ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে।
ভোজ্য তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে গতকাল বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন জারি করে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১০ শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। আগে ভ্যাট ছিল ১৫ শতাংশ। এর আগে ১৪ মার্চ উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমা ও ভ্যাট কমানোর বিষয়ে ভোজ্য তেল পরিশোধন কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা ও টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার কাজী সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি প্রজ্ঞাপন দেখেছি। আমার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। ’ তবে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমানোর প্রস্তাব করেছিলাম। নতুন প্রজ্ঞাপনে কমানো হয়েছে ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় আমরা সরকার নির্ধারিত লিটারপ্রতি বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকায় বিক্রি করতে পারব কি না, হিসাব করে বলতে হবে। এখনই সেটা বলা সম্ভব নয়। ’
কাজী সালাহ উদ্দিন আরো বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে দাম কমবে—এটি আগেভাগেই বলা যাবে না। এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন মিলে একটি জাতীয় কমিটি আছে, যারা দাম নির্ধারণ করে দেয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে সেটি দেখে-শুনে-বুঝে দাম নির্ধারণ করে দেয় কমিটি।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন বলেন, ‘আমরা আগেও দেখেছি ভ্যাট-শুল্ক কমানোর সুফল ভোক্তারা কখনোই পায়নি। সব সময় ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। এবারও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না। ’ নাজের আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাত দিয়ে দেশে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে, শুল্ক কমেছে, তাহলে তেলের দাম কমবে না কেন?’
একাধিক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় নিতে খরচ পড়ে লিটারপ্রতি ১৪৫ টাকা। এর সঙ্গে বন্দর মাসুল, শিপিং মাসুল, সিঅ্যান্ডএফ খরচ, কোয়ারেন্টিন, বিএসটিআই চার্জ যোগ করলে লিটারে খরচ দাঁড়ায় ১৪৭ টাকা। কিন্তু এই তেল খুচরা বাজারে বিক্রির জন্য সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে লিটারে ১৬৮ টাকা।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আল রাজিব এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকমান হোসেন লিটন বলেন, বোতলজাত সয়াবিন তেল আমদানি করে বন্দর থেকে ছাড় নিতে লিটারে ১৬১ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে। আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার হলে লিটারে ১৫ টাকা সাশ্রয় হবে। সে হিসাবে বন্দর থেকে ছাড় নেওয়া পর্যন্ত সব খরচ যোগ করলে লিটারে দাম পড়বে ১৪৭ টাকা।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বলেন, দেশে বেশির ভাগ ভোজ্য তেল অপরিশোধিতভাবে আমদানি হয়। পরিশোধিত তেল আমদানি হয় খুবই কম। অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম আমদানি করে পরিশোধন করে দেশের বাজারে বিক্রি হয়। এতে পরিশোধিত ভোজ্য তেল আমদানির চেয়েও খরচ কম পড়বে।
কাস্টমসের এক রাজস্ব কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টমসে এখন প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল শুল্কায়ন হচ্ছে সর্বনিম্ন এক হাজার ২০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ৬০০ মার্কিন ডলারে। সে হিসাবে কেজি ১.৬ ডলার পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ুক আর কমুক, এই দরেই শুল্কায়ন করছে কাস্টমস। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও বাড়তি দামে শুল্কায়ন হবে না। মূলত তেলের মাধ্যমে অর্থপাচার ঠেকাতেই এই উদ্যোগ কার্যকর করেছে কাস্টমস।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন যে সয়াবিন বা পাম তেল শুল্কায়ন করা হচ্ছে, তার ঋণপত্র খোলা হয়েছে প্রায় আড়াই মাস আগে। তখন দাম অনেক কম ছিল। এই তেল শুল্কায়ন শেষে ডিপো থেকে ছাড়ের পর কারখানায় পরিশোধন শেষে বাজারে বিপণন করতে আরো প্রায় ২০ দিন লাগে। অর্থাৎ ঋণপত্র থেকে বিপণন পর্যন্ত তিন মাস সময় লাগে। সে হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি দামে কেনা তেল আসতে তিন মাস সময় লাগবে। এরপর হয়তো দাম কমে আগের মতো স্বাভাবিক হবে।