এম.এইচ মুরাদঃ
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিথ্যা গল্প আর একের পর এক ফাঁদ পেতে চলেছে মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের পক্ষে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে দেশটি এবার বলছে, তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার মধ্য থেকে মাত্র ৭০০ জনকে নিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়। তবে বাংলাদেশ চায়, কমপক্ষে ১১০০ রোহিঙ্গাকে নিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু হোক।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের এ বিষয়ে জানান, মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমাদের প্রত্যাশা, পর্যায়ক্রমে পরিচয় নিশ্চিত করে সব রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাবে মিয়ানমার। ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা এরই মধ্যে নেপিদোকে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে পরিবারিকভিত্তিক চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা এদের মধ্যে ৭০০ জনকে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাব এখনও পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা করা হয়নি। তবে যতটুকু দেখা গেছে, প্রস্তাবে পরিবারের সদস্যরা আলাদা হয়ে যায়। আমরা পরিবার ভেঙে রোহিঙ্গাদের পাঠাতে চাই না।
তিনি আরও বলেন, যদি পরিবার থেকে আলাদা করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হয়, তা হলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যেতে চাইবে না। আমরা কোনো নেতিবাচক কথা রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে শুনতে চাই না। আমরা মিয়ানমারকে জানিয়েছি, পুরো তালিকা একত্রে নিতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা এ জায়গায় আটকে রয়েছে। এই ১ হাজার ১০০ জনকে মেনে নিলে তাদের পাঠিয়ে দিয়ে আবারও তালিকা পাঠাব মিয়ানমারের কাছে।
ঢাকার কূটনীতিকরা এই বিষয়ে বলেন, মিথ্যা তথ্য আর গল্পের ফাঁদ পেতে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহানুভূতি পেতে চাওয়া মিয়ানমারের পুরনো কৌশল। এবারও একই কৌশল নিয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হলে সেখানে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সেখানে এখনও ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করেনি মিয়ানমার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিকবার রাখাইনের পরিবেশ দেখতে সেখানে সফরের জন্য মিয়ানমারকে বলা হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার এ প্রস্তাবে এখনও কোনো সাড়া দেয়নি। যে ৭০০ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেবে বলছে, তাদের তালিকাও অসম্পূর্ণ। এই ৭০০ জনকে কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায়, কবে নাগাদ এবং এর পরের ধাপ কী হবে এসব বিষয়ে এখনও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি মিয়ানমার। এর আগে মিয়ানমার পরপর দুবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা দিয়েও কথা রাখেনি।
২০১৮ সালের ২৭ মে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর থেকে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ৫৮ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারের শিবির থেকে প্রত্যাবাসনের পর মিয়ানমারের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে পৌঁছেছে, যা ছিল মিথ্যা তথ্য। ওই সময় এ বিষয়ে তৎকালীন শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম এনডিসি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এমন কোনো তথ্য বা ঘটনা জানা নেই’। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে এমন একাধিকবার মিথ্যা তথ্য আর গল্প ফেঁদেছে। সময়ক্ষেপণ করা এবং কথা দিয়ে কথা না রাখা মিয়ানমারের পুরনো অভ্যাস।
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত ১৩ মার্চ কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের বলেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে কিছু অগ্রগতি হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। আমরা আশা করি, এ বছর বড় একটি কিছু হবে।’ সাংবাদিকরা ‘বড় কিছু’ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমরা ঠিক করেছি, দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ না হলে আমরা কোনো তথ্য প্রকাশ করব না। রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘মিয়ানমার সরকারের প্রত্যাবাসন শুরুর কথাকে আমি কোনো গুরুত্বই দিই না। কারণ ১২ লাখ বা যদি ১০ লাখই হয় তার মধ্যে ১ হাজার হলেও হয় ১ শতাংশ, এর মধ্যে ৭০০ জনকে তারা নিল বা না নিল তাতে কিছুই আসে যায় না। এ ছাড়া এর আগেও কয়েক হাজার নিয়ে যাওয়ার কথা তারা দুবার বলেছিল। কিন্তু তাদের নেওয়া যায়নি; কারণ তারা যেতে চায়নি। যে সময় তারা যেতে রাজি হয়নি। সে সময়ের তুলনায় মিয়ানমার এখন আরও বেশি অস্থিতীশীল। ওই সময় মিয়ানমার শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল, এখন মিয়ানমার তার সব জাতিগোষ্ঠীর জন্যই বিপজ্জনক হয়েছে। আর মিয়ানমার এখন ৭০০ জন কেন নিতে চায়, সেটাও দুর্বোধ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে মিয়ানমার যাচাই-বাছাই করে কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষকে চিহ্নিত করেছে। তাই পুরো ৪০ হাজার নয় কেন, মাত্র ৭০০ কেন? তারা যদি বলত যে, যাচাই-বাছাই হওয়া ৪০ হাজারকে নেবে তা হলেও একটা ছোটখাটো অর্থ দাঁড়াত। এখন এটা স্রেফ মিয়ানমারের ধাপ্পাবাজি। তাই এটার কোনো গুরুত্ব নেই। মিয়ানমার আসলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করছে। চীন তাদের সঙ্গে আছে। হয়তো দুদিন পর শুনব চীন বলছে, প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে ইত্যাদি।’
যুক্তরাজ্য প্রবাসী মিয়ানমারের নাগরিক এবং মানবাধিকার কর্মী মং জার্নি এ বিষয়ে বলেন, ‘খুব সহসা রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান দেখছি না। কেননা মিয়ানমারের ক্ষমতায় এখনও জান্তা সরকার। তারা যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন এ সঙ্কট সমাধানের আশা না করাই ভালো। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মনোভাব এবং নিষ্ঠুরতার ধরন হিটলারের মতো। জান্তা সরকার চায় না আরাকানে কোনো রোহিঙ্গা থাকুক। এজন্য তারা বিগত ষাটের দশকেই পরিকল্পনা করেছে, কীভাবে আরাকান অঞ্চল রোহিঙ্গাশূন্য করা যায়। ১৯৬২ সালেই জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দমন-নিপীড়ন শুরু করে। এ কারণে ওই সময় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ভারতে চলে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যত সময় গড়িয়েছে জান্তা বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ততই ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ১৯৭৮ সালে রাখাইনে জান্তা বাহিনী গণহত্যা ঘটায়। এ কারণে ওই সময়ও প্রচুর রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপরের দশকগুলোও রোহিঙ্গাদের জন্য ভয়াবহ ছিল, যা এখনও চলছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চিও রোহিঙ্গা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। সর্বশেষ ২০১৭ সালে যে রাখাইনে যে গণহত্যা ঘটেছে তার পেছনে সু চির হাত ছিল এবং তার সরকারই তখন ক্ষমতায় ছিলো।’