আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে দুই দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ড আরও বাড়বে। আর তাতে লাভবান হবেন দুই দেশের সাধারণ মানুষ। এমনটাই মনে করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাই উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তারা চাইছেন রেল ও সড়ক যোগাযোগের উন্নতি। সেইসঙ্গে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধিতেও উদ্যোগী দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দুই রাষ্ট্রপ্রধান। সাম্প্রতিক দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠকে সেই লক্ষ্যেই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে মন্তব্য করেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ নতুন ট্রেন ও বাস সার্ভিস চালু হলে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি পাবে’। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘আমাদের মধ্যে এ ধরনের নেটওয়ার্ক যত মজবুত হবে, যত যোগাযোগ বাড়বে, তত ভারত ও বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থার উন্নতি হবে’। তাই দুই প্রধানমন্ত্রীই চাইছেন দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। পণ্য পরিবহণের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের যাতায়াতের রাস্তাও প্রশস্ত করতে চান তারা। তাই চালু হচ্ছে একাধিক বাস ও ট্রেন রুট। ভারত এমনিতে বছরে ১৬ থেকে ১৭ লাখ ভিসা দেন আমাদের। তবু ভিসা পদ্ধতিতে জটিলতা এখনও রয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির রোগীদের জন্য ই-ভিসা চালুর প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশের বহু মানুষ আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। চিকিতসার জন্য বাংলাদেশীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভিসা দেবে ভারত। শুধু তাই নয়, রংপুরে ভারত সরকার একজন সরকারি হাইকমিশনারকে নিয়োগ করবে। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই-কমিশনার প্রণয় ভার্মাও জানিয়েছেন, ভিসা পদ্ধতি আরও সহজ করতে তারা চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বাংলাদেশ চাইছে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হতে। তাই ভারতের সঙ্গে রেল সংযোগ অত্যন্ত জরুরি। ভারতের মধ্যে দিয়ে ভুটান বা নেপালে পণ্য পরিবহণের স্বার্থেও আমাদের দিল্লির সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হতে ২০০৭ সালে চুক্তি করে বাংলাদেশ। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর মধ্যে সহজেই পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে। রেল নেটওয়ার্কটিতে যোগ দিতে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দেশের বিদ্যমান রেল অবকাঠামোও শক্তিশালী করার। তবে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেখানকার সামরিক সরকারের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় যেতে রাজি নয়। তবে ট্রান্স-এশিয়া রেলওয়ে নেটওয়ার্ক নিয়ে ঢাকা চিরকালই আগ্রহী। এছাড়াও বাংলাদেশের দর্শনা-ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর-পার্বতীপুর-চিলাহাটি রুট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গেদে থেকে হলদিবাড়ী হয়ে ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত ট্রেন পরিচালনা করতে চায় আওয়ামী লীগ সরকার। এই রুট দিয়ে অনেক সহজেই পণ্য পরিবহণ সহজ হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মঙ্গলের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি চাইলেও শুরু হয়েছে তার বিরোধিতা। বিদেশের মাটিতে লুকিয়ে থেকে অপরাধীর দল সামাজিক গণমাধ্যমকে হাতিয়ার করে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। নির্বাচনে মানুষ তাদের প্রত্যাখান করায় এখন বিদেশ থেকে অপপ্রচার চালানোটাকেই তাদের একমাত্র জীবিকা করে তুলেছে। বিদেশি মদদে ভারত বিরোধিতার নামে বাংলাদেশের বিরোধিতা শুরু করেছে তারা। জামায়াত ও বিএনপির নেতারা তাদের মদদ জুগিয়ে চলেছে।
সামাজিক গণমাধ্যমে ট্রানজিট বা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ার যে প্রচার চলছে তা পুরোপুরি বিভ্রান্তীকর। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সমঝোতা স্মারক বা এমওইউর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তঃদেশীয় কানেক্টিভিটি বা সংযোগ। ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের মধ্যে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যই এমওইউ সই করা হয়। বাংলাদেশ চাইছে ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাইছে। ভারতের মধ্যে দিয়ে ভুটান থেকে বিদ্যুত আনার প্রক্রিয়া চলছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা হয়ে ইউরোপ গেছে তৈরি পোশাকের একটি চালান। তেমনি দিল্লি উত্তর পূর্ব ভারতের দূর্গম পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে পণ্য পাঠাতে চায়। এতে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহণ ব্যবসার পাশাপাশি বন্দর গুলিতে পণ্য ওঠানামার কাজে যুক্তরা বাড়তি রোজগার পাবেন।
রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন সার্ভিস, চট্টগ্রাম ও কলকাতার মধ্যে নতুন বাস সার্ভিস, গেদে-দর্শনা এবং হলদিবাড়ি-চিলাহাটির মধ্যে দলগাঁও পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন পরিষেবা চালু হলে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল যোগাযোগ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশের আসলে কোনও বাস্তব সম্মত যুক্তি নেই।
ভারত বাংলাদেশের রেলওয়ের অবকাঠামোর উন্নয়নে সার্বিক সহযোগিতা করছে। গড়ে উঠেছে আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা রেলে সংযোগের নতুন অবকাঠামো। এটা চালু হলে কলকাতা থেকে আগরতলায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের পথ কমে হবে মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার। উপকৃত হবেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মানুষ। তেমনি বাংলাদেশও ভ্রমণ কর থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধা মিলবে।
২০২১ সালের ৯ মার্চ উদ্বোধন হয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম শহর এবং বাংলাদেশের পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলাকে সংযুক্তকারী মৈত্রী সেতুর। ১.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মৈত্রী সেতুটি নির্মাণে ভারতের খরচ হয়েছিল ১৩৩ কোটি রুপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল মাধ্যমে সেতুটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু সেতুটি এখনও চালু হয়নি। এই সেতু দিয়ে পণ্য ও যাত্রীদের চলাচল শুরু হলে দুদেশই আর্থিকভাবে উপকৃত হবে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ত্রিপুরার সাব্রুম থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সহজেই পণ্য পরিবহণ করতে পারবে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লাখ লাখ শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা ত্রিপুরা রাজ্যের মানুষ। বিনিময়ে আমরাও বন্দর এবং অভ্যন্তরীন পরিবহণ শিল্পের উন্নয়নের হাত ধরে লাভবান হবো। বর্তমানে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে বাংলাদেশের বহু মানুষ বিমানে বা রেলপথে ভারতের অন্য শহরে কম খরচে যাতায়াত করছেন।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে দুই বাংলায় মানুষের যাওয়া-আসা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কে কৌশলে সীমিত করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে একেবারে অস্তমিত হয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। অথচ, ব্রিটিশ আমলে বর্তমানের ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আটটি রেল লাইন চালু ছিল। এখন তিনটি রুট চালু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীর স্বার্থে সবকটি রেল লাইনই ফের চালু করতে চান। চান মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়িয়ে বন্ধুত্বের নতুন নজির গড়তে। সেই বন্ধুত্বের হাত ধরেই দুদেশের মানুষের আর্থিক উন্নয়নেও সচেষ্ট তারা।