এম.এইচ মুরাদঃ
বেশ কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায় এক কিশোরীর আলাপচারিতার নানা ভিডিও। কখনো লাইভ স্ট্রিমিংয়ে এ প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে-খাওয়া কৃষককে যুক্ত করে সবার সামনে তুলে ধরেন তার জীবন সংগ্রামের গল্প, কখনো ডাক্তার, নার্স ও পুলিশসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তুলে ধরেন তাদের কথাগুলো। আবার কখনো অসহায়, গরিব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, দুঃস্থ মা-বোন ও শিশুদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সবার প্রশংসা কুড়ান ওই কিশোরী।
বলছিলাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি প্রবাসী কিশোরী প্রিসিলা নাজনীন ফাতেমার কথা। সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই তাকে ‘প্রিসিলা’ নামেই চেনে।
প্রায় ৪ বছর বয়সে বাবা-মায়ের সাথে আমেরিকায় পাড়ি জমান প্রিসিলা। ছোটবেলায় তার স্বপ্ন ছিলো অভিনেত্রী হয়ে নাটক ও সিনেমায় কাজ করার। সেজন্য ভর্তিও হন হলিউডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি’-তে। স্কুলের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো থেকে নিয়েছিলেন নাচ ও গানের প্রশিক্ষণ। স্কুলে থাকাকালীন পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কারও। কিন্তু একটা সময় গিয়ে প্রিসিলা অনুভব করেন, এসব আসলে তার জীবনে লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। নিউইয়র্কের রাস্তা দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়ার মাঝে বিভিন্ন দৃশ্য তার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। অভিনয়, মডেলিং থেকে ফিরে আসেন সমাজসেবায়।
প্রিসিলা জানান, ‘নিউইয়র্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় দেখতাম ক্ষুধার্ত মানুষেরা গার্বেজের ময়লা থেকে খাবার খুঁজে খাচ্ছে। কনকনে ঠাণ্ডায় শীতবস্ত্রহীন মানুষ বাইরে অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে—এসব আমাকে ভীষণ মর্মাহত করে। তখন আমার মনে হলো- নাচ, গান, অভিনয়ের লোকের অভাব নাই কিন্তু সমাজের অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিতদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের পাশে দাঁড়ানোর মানুষের সংখ্যা কম। একজন মানুষ হিসেবে তাদের পাশে দাড়ানো আমার দায়িত্ব। সে চিন্তা থেকে আমি নাচ, গান, অভিনয় ছেড়ে ২০১৭ সাল খেকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখি। এখন নিয়মিত মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
প্রিসিলা একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলেছেন। নিউইয়র্কে থাকলেও বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছে তার সংগঠনে। গরিব ও অসহায়দের মাঝে খাবারসহ নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিচ্ছে তারা। বিভিন্ন গ্রামে বিশুদ্ধ পানির জন্য আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ ও স্যানেটারি ল্যাপটিন স্থাপন, কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিচ্ছে, গ্রামীণ নারীদের আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সেলাই মেশিন কিনে দিচ্ছে প্রিসিলার ভলান্টিয়াররা।
প্রিসিলা এ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশি হিসেবে আমি সব সময় বাংলাদেশ নিয়ে ভাবি। আমি চাই না কোনো মানুষ খাবারে কষ্ট পাক, বস্ত্রের অভাবে কষ্ট পাক। আমি চাই তারা যেন ভালোভাবে জীবন পার করতে পারে। তাই তাদের পাশে দাঁড়াতেই আমি কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিবছর আমার বাংলাদেশে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে, তার জন্য টাকাও জমাই; কিন্ত যখন কোনো অসহায়ের সাহায্যে জন্য খবর আসে তখন সে টাকা দিয়ে দিই, অনুভব করি আমি দেশে যাওয়ার চাইতে তার সাহায্য টাকাটা ব্যয় করা জরুরি। তবে একদিন বাংলাদেশে যাব। সমগ্র দেশটা ঘুরে দেখব।’
সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিয়ে প্রিসিলার প্রতিদিনকার লাইভ স্ট্রিমগুলো দেখছেন লাখ লাখ মানুষ। প্রিসিলা তার ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের পাশাপাশি কুরআন তেলাওয়াত, আজান, সংগীত, ভিডিওগ্রাফিসহ নানান প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকেন; ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে বিজয়ীদেরকে ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হয় পুরস্কার। বর্তমানে ইউটিউব-ফেসবুক মিলে তার অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে আয় করা পুরো টাকা মানুষের কল্যাণে ব্যয় করছেন প্রিসিলা।
প্রিসিলা এই বছরের জুনে ১২তম গ্রেড সম্পন্ন করে প্রবেশ করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়া। প্রিসিলা জানান, চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে তাকে স্কলারশিপে পড়ার সুযোগ দিতে আগ্রহী, তবে এখনো কোনোটি চুড়ান্ত হয়নি। তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জার্নালিজম এবং ব্রডকাস্টিংয়ে পড়ালেখা করার, আবার আইন নিয়ে পড়ারও ইচ্ছা আছে। ভবিষ্যতে পড়াশোনার পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজ চালিয়ে যাবে বলে জানান প্রিসিলা। মাদার তেরেসা ও প্রিন্সেস ডায়নার মতো মানবতার ফেরিওয়ালাদের মতো নিজের জীবনকে সমাজ সংস্করণে বিশ্ব মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করতে চান এই মানবতাবাদী কিশোরী। বাংলা ভাষাভাষী সবাই আশা করছেন এই মেধাবী মানবিক কন্যা প্রিসিলা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশে ফিরে এসে বর্তমানের ন্যায় এদেশের মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকবে আজীবন।