বাংলাদেশ, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বৈশ্বিক জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনে বাংলাদেশের দায় ও চ্যালেঞ্জ


প্রকাশের সময় :৩ অক্টোবর, ২০২৫ ৯:০৭ : পূর্বাহ্ণ

এম.এইচ মুরাদ:

জলবায়ুর পরিবর্তনে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বখ্যাত মরুভূমি গবেষকেরা বাংলাদেশকে সতর্কও করে আসছেন বারবার। দেশের এসব সমস্যাকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মতো বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের চারটি মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন: এক. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; দুই. প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন অঞ্চলে বেশি হচ্ছে; তিন. কোন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; চার. ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কি না।

বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। ঋতুভেদে আলাদা আমেজ উপভোগ করা যায় বাংলাদেশে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ছাড়াও ঋতুভেদে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙন, ভূমিধস ইত্যাদি মিলিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলা হয় বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ঋতুচক্রের হেরফেরের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও হেরফের ঘটছে।

মূলত ৫ দশক আগেই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব জানতে পেরেছিল অ্যাক্সনমবিল। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জ্বালানি প্রতিষ্ঠান অ্যাক্সনমবিলের বিজ্ঞানীরা অন্তত ৫ দশক আগেই জানতে পেরেছিলেন, আগামী দিনে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি কীভাবে জলবায়ুকে বদলে দেবে তাও নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তারা।

মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন নিউজের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৭০- এর দশকের শেষ দিকে এবং ১৯৮০- এর দশকের শুরুর দিকেই অ্যাক্সনমবিলের বিজ্ঞানীরা এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞানীদের কথা আমলে না নিয়ে বছরের পর বছর জলবায়ু বিজ্ঞানের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করে। বিশ্বজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির পক্ষে ওকালতি করে। 

অ্যাক্সনমবিলের বিজ্ঞানীরা ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা কেমন হবে তাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল-গ্যাস কোম্পানিটির বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ মেয়াদে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টির অনুমান করেছিলেন। একইসঙ্গে, মানুষের আচরণের কারণে ঠিক কোন সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করবে তাও নির্ভুলভাবে অনুমান করেছিলেন। 

বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল সায়েন্সে বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যাক্সনমবিলের কাছ থেকে ফাঁস হওয়া বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ গোপনীয় নথিপত্র বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে সাংবাদিক এবং গবেষকেরা যাচাই বাছাই করেছেন। সেখানে তারা দেখতে পেয়েছেন, অ্যাক্সনমবিল আগে থেকেই জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল সম্পর্কে অবগত ছিল।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জিওফ্রে সুপ্রান বলেছেন, ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল অবধি অ্যাক্সনমবিল শতাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক ঊষ্ণায়ন নিয়ে করা অন্তত ৬৩ থেকে ৮৩ শতাংশ অনুমান নির্ভুলভাবে মিলে গেছে। প্রতিবেদনে প্রতি দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা অন্তত দশমিক ২ ডিগ্রি সেল
জলবায়ুর পরিবর্তনে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বখ্যাত মরুভূমি গবেষকেরা বাংলাদেশকে সতর্কও করে আসছেন বারবার। দেশের এসব সমস্যাকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মতো বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের চারটি মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন: এক. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; দুই. প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন অঞ্চলে বেশি হচ্ছে; তিন. কোন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; চার. ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কি না।

জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো মিথ নয়। এক সময় জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা ও সম্ভাব্যতা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষই কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত। অতিক্ষরা, অতিবৃষ্টি, প্রলয়ঙ্করী ঝড়, তীব্র শীত, অসহনীয় তাপপ্রবাহ, বন্যা ও ভূমিধস আমাদের জানিয়ে দেয় জলবায়ু পরিবর্তন এক কঠিন বাস্তবতা, এক মূর্তিমান চ্যালেঞ্জ।

এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা শুধু কথা দিয়ে হবে না, বাস্তবায়নেই এর সমাধান। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হলে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস লাগবেই লাগবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সব রাষ্ট্রেই পড়ে। কিন্তু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরাই। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের নাগরিকরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের জমি কম কিন্তু মানুষ বেশি। তার ওপরে আবার অনেকাংশে কৃষিনির্ভর জীবন ও জীবিকা।  বাস্তব কারণেই আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবার শিল্পোন্নয়নও সময়ের দাবি। ফলে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক কারণেই আমরা দূষণের দিকে ঝুঁকছি। সেই সঙ্গে অন্যান্য বৈশ্বিক ও আনুষঙ্গিক কারণ তো আছেই।

দূষিত নগরীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম দিকেই। বাতাসে কার্বন। ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর প্রকাশিত The LANCET report on ‘Pollution’ বলছে, দূষণজনিত মৃত্যুর ৯২% ভাগই হয়ে থাকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে।  এর কারণও আছে, শিল্পায়নে আমরা আধুনিক, লাগসই ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করছি না। আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনেও পরিবেশ সচেতনতার অভাব প্রকট। পরিবেশ-দূষণ প্রতিরোধে আমাদের ইতিবাচক পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রের পরিবেশ কার্যক্রম এবং ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ এক কথা নয়। রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিসরে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির আলোকে আইন করছে এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এখন নাগরিক হিসেবে আমাদের এগিয়ে আসার সময়।উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে যে প্রযুক্তিসহায়তা দিতে অঙ্গীকার করেছিল তাও পুরোপুরি পালন করছে না। তাই সার্বিকভাবে জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের অর্জন আশানুরূপ নয়। কিন্তু তাই বলে আমরা থেমে নেই, থেমে থাকলে চলবেও না। নাগরিক হিসেবে পরিবেশসচেতন, রাষ্ট্র হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেই এগিয়ে যেতে হবে।

ট্যাগ :