এম.এইচ মুরাদঃ
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন এক নম্বরে। দ্বিতীয় স্থান বাংলাদেশের। আবার বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। চীন ও ভিয়েতনাম এখন বেকায়দায়। করোনাভাইরাস এর উৎস দেশ চীনে আবার ফিরে গেছে। দেশটির উল্লেখযোগ্য অংশ এখন লকডাউনে। আবার তাদের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক দিন ধরে চলছে শুল্কের লড়াই। বাংলাদেশ এ অবস্থার সুবিধা পাচ্ছে। ক্রেতারা এখন বাংলাদেশমুখী। অবশ্য পোশাক রপ্তানিতে এই স্বস্তিদায়ক অবস্থা চলার মাঝে সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ার কারণে নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকনির্ভর। চলতি অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকতেই রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে গেছে। পোশাক রপ্তানিকারকদের হাতে এখনও বেশ রপ্তানি আদেশ রয়েছে। এ খাতে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি হবে। গত অর্থবছরে ৩১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এক আলোচনা সভায় বলেন, পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশের অনুকূলে। সুযোগ কাজে লাগাতে উচ্চমূল্যের পণ্যে বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা। পোশাকের দর বৃদ্ধির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা। ন্যায্য দরের বিষয়ে আপস না করতে বিজিএমইএর সদস্য কারখানাগুলোকে আহ্বান জানানো হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ, বন্দরসহ অন্যান্য অবকাঠামো সুবিধা এবং নন-কটন পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক্কছাড় পাওয়া গেলে বড় অঙ্কের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব।
কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে পোশাক খাতের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁদের একজন বিসমিল্লাহ অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান। তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে পোশাক কারখানা চালান তিনি। এ বছর রপ্তানি আদেশ গত কয়েক বছরের চেয়ে অনেক ভালো। এ কারণে কিছু কাজ সাব-কন্ট্রাকটিং বা ঠিকা কারখানা থেকে করিয়ে নিচ্ছেন। ক্রেতারাই এমন পরামর্শ দিয়েছেন।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার আগে থেকেই মজুরি বাড়ার কারণে চীনের সক্ষমতা কমতে শুরু করে। এ ছাড়া কার্বন নিঃসরণ কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে চীন সপ্তাহে তিন দিন উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অ্যাপারেল রিসোর্সের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাক ও বস্ত্র রপ্তানিতে চীনের দাপট খর্ব হচ্ছে। করোনার সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে পড়ে চীনের রপ্তানি পরিস্থিতি হয়তো আর করোনার আগের পরিস্থিতিতে ফিরতে পারছে না। অথচ ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ সব বড় বাজারে পোশাকের চাহিদা করোনা-পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরে গেছে। লকডাউনে চীন ও ভিয়েতনামের কারখানা বন্ধ থাকায় ক্রেতারা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায় রপ্তানি আদেশ দিচ্ছে। ইনডিটেক্স, গ্যাপ, নেক্সট, সিঅ্যান্ডএ, প্রাইমার্কের মতো ব্র্যান্ড চীন ও ভিয়েতনাম থেকে কিছু অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তর করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিতে ২০১৫ সালে চীনের অংশ ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি গত প্রায় তিন বছর ধরে বাড়ছেই। বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের গেল এপ্রিল পর্যন্ত সে দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। এ সময় সার্বিক পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৬ শতাংশের মতো।
এএনজেড অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরানুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছ থেকে আগের তুলনায় বেশি রপ্তানি আদেশ পাচ্ছেন তাঁরা। অনেক ক্রেতাই চীন থেকে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে।
কমপ্লায়েন্ট কর্মপরিবেশের সুবিধা এবং করোনাকালে বাংলাদেশ যে সক্ষমতা দেখিয়েছে, তাতে আস্থা বেড়েছে ক্রেতাদের। চীন থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে আনার অন্য কারণ হিসেবে চীনের উৎপাদনশীলতা কমে আসার কথা বলেছেন মিথিলা টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আজহার খান। তিনি বলেন, কার্বন নিঃসরণ কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে চীন সপ্তাহে তিন দিন উৎপাদন বন্ধ রাখে। এর সঙ্গে লকডাউন মিলে দেশটির শত শত কারখানা এখন বন্ধ। এ কারণে ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা বাংলাদেশমুখী।
অ্যাডাম অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল হক মুকুল জানান, যে কারণে চীনকে এড়িয়ে চলছে মার্কিন ক্রেতারা তা ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও কিছুটা খাটে। কারণ, নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় চীনা উদ্যোক্তাদের কারখানা বেশি ভিয়েতনামে। এ ছাড়া ভিয়েতনামেরও সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি বলেন, একটি ব্র্যান্ড ভিয়েতনামে কারখানা খুলতে তাঁকে সরাসরি অনুরোধও করেছে।
ডেনিম এক্সপার্টের পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ আপাতত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাণিজ্যে তেমন প্রভাব ফেলেনি। তবে যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ম্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে ভোগক্ষমতা এবং চাহিদা কমার আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। এসব কারণে রপ্তানির বর্তমান ধারা কমে আসবে বলে মনে করছেন তাঁরা। কোনো কোনো ক্রেতা এখনই রপ্তানি আদেশ চূড়ান্ত করতে কিছুটা সময় নিচ্ছেন। রপ্তানি বেশি সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভালো মুনাফা পাচ্ছে না বলে মনে করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, রপ্তানি বাড়ছে, যা দেশের জন্য ভালো খবর। তবে মুনাফা খুব বেশি পাচ্ছেন না রপ্তানিকারকরা। তুলাসহ সব ধরনের কাঁচামালের দর বেড়েছে। পণ্যের দর কিছুটা বেড়েছে। তবে যে হারে আমদানি ব্যয় বেড়েছে সে হারে রপ্তানিতে দর পাওয়া যাচ্ছে না বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে আশার কথা হলো চীনকে পোশাক শিল্পে যেভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বয়কট করতে চেষ্টা করছে তাতে বুঝা যায় সেইদিন আর বেশি দূরে নেই যেইদিন চীনকে টপকিয়ে পোশাক শিল্পে এক নম্বর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উঠে আসবে। সরকারের পাশাপাশি দেশের পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত সকলের আরো একটু বেশি চেষ্টা ও আন্তরিকতায় পারে সেই সাফল্যকে অতিশীগ্রই হাতের মুঠোয় আনতে।