এম.এইচ মুরাদ:
৬৩টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ আর মাথাপিছু আয় ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। এশিয়ার দেশগুলোর পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে নগরায়িত দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য করেই বর্তমানে এই অবস্থানে এসেছে দেশটি।
মালয় ভাষা, চীনা ভাষার বিভিন্ন উপভাষা, ইংরেজি ভাষা এবং তামিল যৌথভাবে সিঙ্গাপুরের সরকারি ভাষা। সিঙ্গাপুরে আরো প্রায় ২০টি ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে জাপানি ভাষা, কোরীয় ভাষা, মালয়ালম ভাষা, পাঞ্জাবি ভাষা এবং থাই ভাষা উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি ভাষা সার্বজনীন ভাষা হিসেবে ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডেও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি মালয় উপদ্বীপের নিকটে অবস্থিত। এর আনুষ্ঠানিক নাম প্রজাতন্ত্রী সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের কাঠামোয় সংঘটিত হয়। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারের প্রধান। দেশটিতে মূলত একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেশি। দেশের নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার ও আইনসভার দায়িত্বে পড়ে। বিচার বিভাগ নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন বিভাগ থেকে স্বাধীন। আইনসভার সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান হলেও এতদিন তার ভূমিকা ছিল আলংকারিক। তবে ইদানিং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিসর কিছু বাড়ানো হয়েছে।
সিঙ্গাপুর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণতম প্রান্তে, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত। সিঙ্গাপুরের স্থলভূমির মোট আয়তন ৬৯৯ বর্গকিলোমিটার। এর তটরেখার দৈর্ঘ্য ১৯৩ কিলোমিটার। এটি মালয়েশিয়া থেকে জোহর প্রণালী এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ডটি একটি হীরকাকৃতি দ্বীপ, তবে এর প্রশাসনিক সীমানার ভেতরে আরো বেশি কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ অবস্থিত। এদের মধ্যে পেদ্রা ব্রাংকা নামের দ্বীপটি সিঙ্গাপুর থেকে সবচেয়ে বেশি দূরত্বে অবস্থিত। সিঙ্গাপুরের সীমানার অন্তর্গত কয়েক ডজন ক্ষুদ্রাকার দ্বীপের মধ্যে জুরং দ্বীপ, পুলাউ তেকোং, পুলাউ উবিন ও সেন্তোসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বড়।
সিঙ্গাপুর দ্বীপের বেশিরভাগ এলাকা সমুদ্র সমতল থেকে ১৫ মিটারের চেয়ে বেশি উঁচুতে অবস্থিত নয়। সিঙ্গাপুরের সর্বোচ্চ বিন্দুটির নাম বুকিত তিমাহ; এটি সমুদ্র সমতল থেকে ১৬৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত গ্র্যানাইট পাথরে নির্মিত একটি শিলা। সিঙ্গাপুরের উত্তর-পশ্চিমে আছে পাললিক শিলা দ্বারা নির্মিত ছোট ছোট টিলা ও উপত্যকা, অন্যদিকে পূর্বভাগ মূলত বালুময় সমতল ভূমি দিয়ে গঠিত। সিঙ্গাপুরে কোনো প্রাকৃতিক হ্রদ নেই, তবে সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর প্রশাসন সমুদ্রতলের মাটি, পর্বত ও অন্যান্য দেশ থেকে মাটি সংগ্রহ করে দেশটির স্থলভাগের আয়তন বৃদ্ধি করে চলেছেন। ১৯৬০-এর দশকে দেশটির আয়তন ছিল প্রায় ৫৮২ বর্গকিলোমিটার, বর্তমান এটি ৭১৬ বর্গকিলোমিটার এবং ২০৩৩ সাল নাগাদ এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে আরো ১০০ বর্গকিলোমিটার। সিঙ্গাপুর বিষুবরেখার মাত্র ১ ডিগ্রি উত্তরে অবস্থিত বলে এখানকার জলবায়ু নিরক্ষীয় প্রকৃতির।
১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সিঙ্গাপুর ব্রিটিশদের অধীনে একটি ‘ক্রাউন কলোনি’ ছিল। এই দ্বীপটি পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি থাকার কারণে সিঙ্গাপুরকে তখন ‘জিবরালটার অব দা ইস্ট’ বলা হত। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ ক্যানাল খোলার পর ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে সমুদ্র বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, ঠিক তখনই সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়।
আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হচ্ছে সিঙ্গাপুর। অথচ ১৯৫৯ সালেও এটি অপরাধ ও দরিদ্রে জর্জরিত ছিল। ১৯৬৫ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের বছরে এই দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৫১৬ মার্কিন ডলার। এই ৫১৬ ইউ.এস. ডলার ছিল তখন পূর্ব এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। স্বাধীনতার পরে ইউরোপ থেকে বিনিয়োগ আসার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হওয়া শুরু করে। আশির দশকের মাঝখান দিকে এই দেশটি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে।
সিঙ্গাপুরের সংস্কৃতি পশ্চিমা ঘরানার হলেও এখানে গোঁড়া হিন্দুবাদ, গোঁড়া খ্রিষ্টানবাদ , গোঁড়া ইসলামবাদ (মালয় সংস্কৃতি) এবং গোঁড়া বৌদ্ধবাদ (চাইনিজ সংস্কৃতি) আছে। পর্যটন সিঙ্গাপুরের অন্যতম প্রধান শিল্প এবং দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন পর্যটক সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করে।
১৯৬৫ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে সিঙ্গাপুর স্বাধীনতা লাভ করে। সে সময়কার সিঙ্গাপুরের চেহারা ছিল আজকের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ঘাট, নিয়ন্ত্রনহীন যানবাহন, রুগ্ন, দরিদ্র মানুষে ভর্তি রাস্তা-ঘাট। সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনাদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মালয় ও ভারতীয়দের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদ ছিল চরমে। অপরাধ আর খুন-খারাবির কোনো বালাই ছিল না। দুর্নীতি, অশিক্ষা আর ঘিঞ্জি ছিল চারপাশ।
দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথপিছু আয়ের দেশে পরিণত হয় সিঙ্গাপুর। এ কারণে তাকে বলা হয় আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক। লি কুয়ান মানুষের যে গুণটাকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেন তা হচ্ছে ”সততা”। শিক্ষা দীক্ষা, মেধার ওপরে স্থান হচ্ছে সততার। সিঙ্গাপুরের প্রতিটা মানুষের মাঝে তিনি এই সততার ভিতটা গভীরভাবে গেঁথে দিয়েছেন। সিঙ্গাপুরের সরকার সবসময়ই একটি স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত সরকার হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে সিঙ্গাপুর বহুদিন ধরেই এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশ।