আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে যখন আন্তর্জাতিক বিশ্বের একটা বড় অংশ প্রবলভাবে সরব, তখন ভারত কিন্তু মোটের ওপর তাদের পুরনো বন্ধুর পাশেই দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘে তারা একবারও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেয়নি – এমন কী রুশ অভিযানকে তারা ‘যুদ্ধ’ তো দূরে থাক, এখনও ‘ইনভেশন’ বলতেও রাজি হয়নি।
ইউক্রেন সংকটের মধ্যে ভারতের এই ধরনের কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে বিদেশে যেমন, দেশের ভেতরেও ব্যাপকভাবে চর্চা হচ্ছে। আর সেখানে ভারতের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের মত হলো, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে ভারতকে সমর্থন করেছিল – পঞ্চাশ বছর বাদে আজ ভারতেরও তার প্রতিদান দেওয়ার পালা।
রাশিয়াকে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের পেছনে অবশ্যই আরও নানা কারণ আছে, কিন্তু মস্কো ও দিল্লির ‘টাইম-টেস্টেড’ (কালোত্তীর্ণ) মৈত্রীর সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞান যে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তা নিয়ে ভারতের সোশাল মিডিয়ায় কিন্তু কোনও দ্বিমত নেই।
কয়েকটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ‘ডিফেন্ডার অব ইন্ডিয়া’ নামে একটি জনপ্রিয় টুইটার হ্যান্ডল থেকে পোস্ট করা হয়েছে, আজ রাশিয়াকে ভারতের সমর্থনের পেছনে একটা কারণই যথেষ্ঠ – আর সেটা হলো ১৯৭১। তারা বলছে, পূর্ব পাকিস্তানে নির্মম গণহত্যা চালানো সত্ত্বেও ইসলামাবাদকে অস্ত্র সরবরাহ করতে আমেরিকা কিন্তু সেদিন এতটুকুও দ্বিধা করেনি। যে পরাশক্তি সেদিন ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছিল তারা সোভিয়েত, এ কথা আমরা ভুলতে পারি না।
ভারতের তরুণ প্রজন্মের শিল্পপতি ও কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাংকের অন্যতম কর্ণধার জয় কোটাক একই বক্তব্য লিখেছেন আরও চাঁছাছোলা ভাষায়, ‘জাতিসংঘে ভারতের ভোটদানে বিরত থাকার একটা ঐতিহাসিক পৃষ্ঠভূমি আছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে জেনোসাইড চালিয়েছিল। আমেরিকা সেই পাকিস্তানকেই সমর্থন করে, ভারতকে ভয় দেখাতে বঙ্গোপসাগরে এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার পাঠায়। আর রাশিয়া আমাদের নিঃশর্তে সমর্থন করেছিল। কূটনীতির শিকড় কিন্তু ইতিহাস আর রিয়ালপলিটিকেই প্রোথিত থাকে!’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফরে প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের সঙ্গে তার সুদীর্ঘ আলোচনার পরিণতিতে যে ‘সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেটাই যে পরে মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সে কথা অনেক ঐতিহাসিকই লিখেছেন।
ইন্দিরা গান্ধী ও ব্রেজনেভ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরের আগস্টে
ইন্দিরা গান্ধী ও ব্রেজনেভ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরের আগস্টে
আমেরিকা যে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে দ্বিধায় ভুগেছে এবং চীনকে ওই যুদ্ধের ধারেকাছে কোথাও দেখা যায়নি – তার পেছনে সেই মৈত্রী চুক্তির বিরাট অবদান ছিল।
আজ তার অর্ধশতাব্দী বাদে ইউক্রেন সংকটের সময় ভারত কিন্তু রাশিয়ার সেই সমর্থন ও সহযোগিতারই প্রতিদান দিচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধীর দল কংগ্রেস দেশের ক্ষমতায় নেই বহুদিন, কিন্তু মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারও সেই পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে।
ভারতের এই রাশিয়াপন্থী অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করে মার্কিন কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্সের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এন হাস গত সপ্তাহে খুব কড়া একটি টুইট করেছিলেন। তার জবাবে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও বর্ষীয়ান কূটনীতিবিদ কানওয়াল সিবালও কিন্তু সেই একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গই টেনে এনেছেন।
কানওয়াল সিবাল লিখেছেন, ‘যে আমেরিকা দশকের পর দশক ধরে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থকে আঘাত করেছে, জিহাদ আমদানি করেছে, একাত্তরে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে, তারা কীভাবে আমাদের দোষারোপ করে? আমেরিকা বরং নিজের দিকে তাকাক।
দিল্লিতে বহু বছর দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদক ছিলেন অ্যামি ক্যাজমিন। তিনিও টুইট করছেন, “আমার মনে পড়ছে মোদি একবার পুতিনকে বলেছিলেন, ‘ভারতের প্রতিটি দুধের শিশুও জানে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া!’”
তবে রাশিয়াকে এই সমর্থনকে ঘিরে ভারতের ভেতরে আপত্তিও যে একেবারে উঠছে না, তা নয়।
নামী গবেষক, শিক্ষাবিদ ও কাশ্মিরে সরকারের নিযুক্ত সাবেক মধ্যস্থতাকারী রাধা কুমার যেমন একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘রাশিয়াকে এই প্রচ্ছন্ন সমর্থনের চেয়ে বড় স্ট্র্যাটেজিক ভুল আর কিছু হতেই পারে না।’
অধ্যাপক রাধা কুমার যুক্তি দিয়েছেন, রাশিয়া এখন আর ভারতের জন্য তত নির্ভরযোগ্য মিত্র দেশ নয়।
পুতিনের আমলে ভারতে রুশ অস্ত্র ও সামরিক সরবরাহ বারেবারে বিঘ্নিত হয়েছে, দফায় দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে এবং চীনের সঙ্গে সংঘাতের সময়ও মস্কো মোটেই দিল্লির পাশে দাঁড়ায়নি।
কিন্তু ভারতের সোশাল মিডিয়াতে অন্তত বেশিরভাগ মানুষ এই বক্তব্য আমলে নিতে প্রস্তুত নন – তারা মনে করছেন একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিশ্বস্ত সঙ্গীকে আজ সমর্থন করে ভারত একদম ঠিক করেছে!