এস.এম তৌহিদ:
দেশের ব্যাংক খাতে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য চোখে পড়েনি বিদায়ী ২০১৯ সালে। সমস্যায় জর্জরিত ব্যাংক খাতকে সমস্যা থেকে উত্তরণে নানা উদ্যোগের কথা বললেও কার্যত কোনো ফল মেলেনি।
সুদহার এক সংখ্যায় নামাতে নেওয়া উদ্যোগ উদ্বেগে পরিণত হয়; নতুন ব্যাংক অনুমোদন দিলেও কাজ শুরু করতে পারেনি; দুর্নীতি অব্যবস্থায় নিমজ্জিত ব্যাংককে সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ দিলেও দাঁড়াতে না পারা এবং শত চেষ্টার পরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের পথে যেতে হয় ২০১৯ সালে।
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পদ্মা ব্যাংক:
অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং। ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে কয়েক দফা পরিবর্তন করেও ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়। বরং অবস্থা আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ কোটি টাকার তহবিল নিয়ে ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে এগিয়ে আসে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও আইসিবি। কিন্তু ফল মেলেনি। ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক নামে যাত্রা শুরু করে। তারপরও বছর জুড়ে ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যায়নি। একই অবস্থা হয় বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংয়ের। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশ ব্যাংক নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যায় রেখেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। শেষে অবসায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া হয়। অবসায়নের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে উচ্চ আদালতে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করে।
সুদহার কমনোর ব্যর্থ চেষ্টা:
সুদহার কমাতে সরকার প্রধান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে বার বার ব্যাংক উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও সুদহার কমাতে ব্যর্থ হয়। সুদহার কমানোর সুবিধা হিসাবে সরকারের কাছে থেকে কম সুদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের হার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করিয়ে নেওয়া হয়; ব্যাংকগুলোর বিধিবদ্ধ জমার হার এক শতাংশ কমিয়ে নেওয়া হয়; কর্পোরেট ট্যাক্স ৩৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩৬ শতাংশ করিয়ে নেয়। এ জন্য কম সুদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা আমানতসহ ট্যাক্স মওকুফ সুবিধা পায়। কিন্তু সুদহার কমাতে কোনো ফলই আসেনি। বরং ক্ষেত্র বিশেষে সুদহার আরও বৃদ্ধি পায়। সুদহার কমানোর এই কানামাছি খেলা চলে বছরজুড়ে। শেষে সরকারের নির্দেশে সুদহার না কমার কারণ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমিটি তথ্য পায় পুরো ব্যাংক খাতে সুদহার নয় শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। কমিটি সুপারিশ করে সব খাতে নয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে শুধু শিল্প খাতের উৎপাদন উপখাতে সুদহার নয় শতাংশ করা যায়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করে জানুয়ারি থেকে এ উপ-খাতে সুদহার নয় শতাংশে নামানো হবে।
খেলাপি ঋণ কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা:
অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু এ ঘোষণা কোনো কাজেই আসেনি। বরং বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৯ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ৯ মাসে ২২ হাজার ৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা:
বর্তমান সরকার চলতি মেয়াদে সরকার গঠন করার পর পরই খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়। বিভিন্ন সময় খেলাপি ঋণ কমাতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু কাজ হয়নি। এরপর খেলাপি গ্রাহকদের নতুন করে প্যাকেজ ঘোষণা করে। এসব সুবিধার মধ্যে রয়েছে-চলতি বছরের ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহারের সীমা ঠিক করে দেওয়া হয় নয় শতাংশ। এ সুবিধা শেষ হবে ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।
বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে বিশেষ নীতিমালা:
এ ছাড়া ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে বিশেষ নীতিমালা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় ১১ শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। শিল্প গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে-বেক্সিমকো গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, আবদুল মোনেম লিমিটেড, কেয়া গ্রুপ, এসএ গ্রুপ (এসএ অয়েল রিফাইনারি ও সামান্নাজ), বিআর স্পিনিং, এননটেক্স গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ এবং রাইজিং স্টিল। এ সব শিল্প গ্রুপের বেশির ভাগ ঋণ আবারও খেলাপি হয়ে পড়ায় ২০১৯ সালে নতুন করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করলেও বিশেষ কোনো কারণে এখন অনিয়মিত হয়ে পয়েছেন শুধু তারাই পুনঃতফসিলের এই নতুন সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন।
নতুন ৩ ব্যাংক অনুমোদন:
২০১৯ সালে নতুন তিন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলো হলো-বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন ব্যাংক। প্রাথমিকভাবে আগ্রহপত্র বা লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) পাওয়ার পরও শর্ত অনুযায়ী পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহসহ বিভিন্ন নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় এখনো চূড়ান্ত লাইসেন্স পায়নি এসব ব্যাংক। চলতি বছর কার্যক্রম চালু করেছে পুলিশের মালিকানাধীন কমিউনিটি ব্যাংক।
রেমিট্যান্সে সুবাতাস:
ব্যাংক খাতের নানা দুঃসংবাদের পরও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স আহরণে সুখবর আছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। ব্যাংকি খাতের এই সুসংবাদকে নতুন বছরের সম্ভাবনার আলো বলে মনে করছে ব্যাংকাররা।