স্টাফ রিপোর্টারঃ
মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয় বরিশাল নগরের পলাশপুর এলাকার বাসিন্দা রানু বেগমের (৫০)। স্বজনেরা দ্রুত তাঁকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আনেন। হাসপাতালে আনার পর ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করতে গিয়ে আড়াইটা বেজে যায়। সময় যত যায়, রানু বেগমের শ্বাসকষ্ট আরও বাড়তে থাকে। করোনা ওয়ার্ডে নেওয়ার পর চিকিৎসক দ্রুত তাঁকে কৃত্রিম অক্সিজেন দিতে বলেন।
রানু বেগমের ছেলে আল আমিন ও দেবরের ছেলে মাইনুল দ্রুত অক্সিজেনের জন্য ছুটে যান ইউনিটের দোতলায় ওয়ার্ড মাস্টারের কক্ষে। ওয়ার্ড মাস্টারের কক্ষে গেলে তিনি আবার পাঠান তিন তলায় নার্সের কক্ষে। আল আমিন পাগলের মতো ছুটে যান নার্সের কক্ষে। সেখানে গিয়ে অক্সিজেনের কথা বললে কর্তব্যরত নার্স তাঁকে পুনরায় ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে যেতে বলেন। আবার তাঁরা ছুটে যান ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে। ওয়ার্ড মাস্টার এবার বিরক্ত হয়ে তাঁদের ধমকান। হাসপাতালের যেখান থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, সেখানে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে আল আমিন ও মাইনুল দেখেন দীর্ঘ লাইন। তাঁরা সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীকে বলেন, তাঁদের রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। ওই কর্মচারী তাঁদের লাইনে দাঁড়াতে বলেন। এরপরও সিলিন্ডারের জন্য আকুতি করতে থাকলে ওই কর্মচারী আল আমিন ও মাইনুল অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন।
স্বজনেরা দুপুর ২টার দিকে তাঁকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আনেন। অক্সিজেন না পেয়ে পৌনে ৫টার দিকে চিরতরে থেমে যায় রানু বেগমের হৃৎস্পন্দন। নিরুপায় হয়ে রানু বেগমের ছেলে-ভাতিজা সেখানে অপেক্ষা করতে থাকেন। এদিকে সময় গড়াতে থাকে। আল আমিন কখনো দৌড়ে মায়ের কাছে, আবার কখনো সিলিন্ডারের কাছে ছুটে আসেন পাগলের মতো। রানু বেগম তখন তীব্র শ্বাসকষ্টে ছটফট করছিলেন। তীব্র কষ্টে তাঁর চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। পৌনে ৫টার দিকে আল আমিন ও মাইনুল একটি সিলিন্ডার পান। কিন্তু ততক্ষণে রানু বেগম নিস্তেজ হয়ে গেছেন। চিরতরে থেমে যায় রানু বেগমের হৃৎস্পন্দন।
রানু বেগম বরিশাল নগরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পলাশপুর নতুন ব্রিজ এলাকার বাসিন্দা আবদুল জলিলের স্ত্রী। ভাতিজা মাইনুল বলেন, তাঁর চাচির এত দিন জ্বর থাকলেও আজ সকাল থেকে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। বেলা ২টার দিকে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে এলে সেখান থেকে করোনা ইউনিটে ভর্তি করাতে বলা হয়। পরে ভর্তি করা হলে চিকিৎসক অক্সিজেন দিতে বলেন। কিন্তু অক্সিজেন পাননি তাঁরা। সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা, উদাসীনতা আর দুর্ব্যবহার তাঁদের স্তম্ভিত করেছে বলে জানান।
রানু বেগমের ছেলে আল আমিন মায়ের মৃত্যুর পর কাঁদছিলেন। বলছিলেন, ‘আম্মাকে বাঁচানো গেল না। এখানে মানুষ কেন আসে? হাসপাতালে আনার পর তিন ঘণ্টা একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য পাগলের মতো হন্যে হয়ে ঘুরেছি। আমাদের তা দেওয়া হয়নি। ট্রলিতে মাকে তোলার জন্য আমাদের কাছে ১৫০ টাকা দাবি করা হয়েছে। টাকা ছাড়া এখানে অক্সিজেন মেলে না। এখানে নিয়ে আসার পরে একজন ডাক্তার, নার্স কেউ কাছে আসেননি। ছটফট করতে করতে অক্সিজেনের অভাবে মা মারা গেছেন। সঠিক সময়ে অক্সিজেন আর চিকিৎসা পেলে আমার মা মারা যেতেন না।’
এ সময় রানু বেগমের আরও দুই স্বজন অভিযোগ করেন, হাসপাতাল সরকারি হলেও এখানে টাকা ছাড়া কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায় না। একটি সিন্ডিকেট করে মানুষের অসহায়ত্বকে জিম্মি করে টাকা আদায় করছে।
জানতে চাইলে করোনা ওয়ার্ডের ওয়ার্ড মাস্টার মশিউর রহমান বলেন, তিনি কোনো রোগীর স্বজনকে গালিগালাজ করেননি। তা ছাড়া অক্সিজেনে দেওয়ার এখতিয়ার তাঁর নেই। অক্সিজেন দিয়ে থাকেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সরা।
করোনা ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামান শাহীন বলেন, ‘করোনা ইউনিট থেকে অক্সিজেন দেওয়া হবে না, এমন হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি আমার জানা নেই। আসলে কী ঘটেছিল, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’