এম.এইচ মুরাদ:
জীবনের লক্ষ্য যদি কেউ খুঁজে পেতে চায়, ফজলে হাসান আবেদের মত মানুষদের জীবনই তার জন্যে পাথেয় হতে পারে। ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি’- প্রবাদ যদি কেউ বুঝতে না পারে এই অস্থির স্বার্থপর যুগে, তাকে একজন স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ, যদিও স্যার নয়, কেউ ভাই বলে ডাকলে তিনি বেশি খুশি হতেন। জীবনের শুরুতে তিনি হতে চেয়েছিলেন কবি, রবীন্দ্রনাথ তাকে ভালোই প্রভাবিত করেছিলেন। আক্ষরিক অর্থে কবি হয়ে ওঠা হয় নি, কিন্তু তিনি সত্যিকার অর্থে বাংলায় এমন কবিতা সৃষ্টি করেছেন যা জীবনব্যবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আবেদ ভাইয়ের কবিতাটির নাম ‘ব্র্যাক’। হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং, এশিয়ার সর্ববৃহৎ গ্রাম যেটি, সেই গ্রামে জন্মেছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। সেই মানুষটা একদিন হবেন পৃথিবীর বৃহত্তম এনজিও’র উদ্যোক্তা৷ তার আগে মেমোরি লেনে স্যারের জীবনের গল্পে ঘুরে আসি৷
মেমোরি লেনে আবেদ ভাই:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ব্রিটেন গিয়েছিলেন, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়তে শুরু করেছিলেন। কিন্তু, কিছুদিন বাদে মনে হয়েছে, এই বিষয়ে পড়া চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তিনি বিষয় বদলে ফেললেন। লন্ডনে চলে গেলেন, পড়লেন চাটার্ড একাউন্টিংয়ের উপর। ভেতর থেকে প্রেরণাজাত সহজাত প্রবৃত্তির উপর বিশ্বাস রেখে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে ফেরার প্রয়াসটা তার ছাত্রজীবন থেকেই যে ছিল, তার প্রমাণ এই বিষয়বদলের ঘটনাটি। আমরা দেখবো আরো পরে, যখন পথ দেখানোর কেউ ছিল না, তখন ফজলে হাসান আবেদ কিভাবে নিজের মনের বিশ্বাসে ভর করে দারুণ সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
এখানে বলা প্রয়োজন, লন্ডনে থাকার সময়ে তিনি সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে দূর্বল হয়ে পড়েন। ইউরোপীয় সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্যের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি প্রচুর পড়তেন। আজকের দিনে বই পড়া এক দুর্লভ গুনাবলি হয়ে উঠছে। বই মানুষকে মানবিক করে তোলে, গল্প মানুষকে কোমল করে তোলে, ভাবনার দিগন্তকে ছড়িয়ে দেয় তেপান্তরে। কেন একজন ফজলে হাসান আবেদ সারাজীবন মানুষের জন্যেই কাজ করলেন, শেষ দিন অবধি ভেবে গেছেন মানুষের কথা, গেয়েছেন মানুষের গান তার উৎস, প্রেরণা বুঝতে হলে সাহিত্যের প্রতি মানুষটার অনুরাগকে উপলব্ধি করতে হবে।
সত্তুরের ঘূর্ণিঝড় ও জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া:
নিশ্চিন্তের একটা জীবন চাইলেই যাপন করার দারুণ সুযোগ ছিল তার। লন্ডন, কানাডা, আমেরিকায় চাকরি করেছেন। তারপর যখন স্থায়ীভাবে দেশে ফিরলেন ১৯৬৮ সালে তখনো বহুজাতিক শেল ওয়েল কোম্পানির লোভনীয় চাকরিতে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু, ১৯৭০ সাল তার জীবনকে এলোমেলো করে দিলো। ৫ নভেম্বরের সেই ভয়াল রাত, প্রলয় ঘটাতে বাংলাদেশে আঘাত হানলো ভয়ংকর এক ঘূর্ণিঝড়৷ ফজলে হাসান আবেদের মনে কেবল একটাই কথা ঘুরতে থাকলো। আজ রাতই হবে কত সহস্র মানুষের জীবনের শেষ রাত। যারা এই লড়াইয়ে বেঁচে থাকবেন, তাদের জীবনেও অসংখ্য রাত আর কোনো সুখবর বয়ে আনবে না।
৫ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল সত্তুরের নভেম্বরে। এই ঘটনাটি প্রবলভাবে আঘাত করেছিল স্যার ফজলে হাসান আবেদকে৷ তিনি তখন সুখী, নিশ্চিন্তের এক জীবন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু, নভেম্বর তার মনে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, মানুষের দুঃখে সহমর্মিতাবোধের সেই সহজাত প্রবৃত্তিকে নাড়া দিলো৷ স্বচ্ছল, সুখী জীবন, এই বহুজাতিক কোম্পানির আরামের চাকরিকে তার অবাস্তব মনে হলো। বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়ে স্বার্থপরের মতো বাঁচতে চান নি তিনি। তিনি ভাবলেন, অন্যদের জীবন থেকে নিজেকে আলাদা করে বেঁচে থাকার কি কোনো মানে আছে? যখন চারদিকে আর্তনাদ, দুঃখ বিষাদ তখন ব্যক্তিগত সুখে ডুবে থাকাটা কোনো মানুষের উদ্দেশ্য হতে পারে না। এমনই ছিল তার উপলব্ধি।
তিনি বসে থাকতে পারলেন না। ঘর ছেড়ে বেরুলেন। শোকে কাতর, ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙ্গে পড়া জীবনগুলোর কাছে গেলেন। করলেন হেল্প নামে একটি সংগঠন কজন বন্ধু নিয়ে। ত্রাণকার্য পরিচালনা করলেন মনপুরা দ্বীপে, বিপন্ন জনপদের মানুষগুলোর দরবারে বাড়িয়ে দিলেন নিজের আত্মা।
অহিংস এক বিপ্লবীর জন্ম যখন…
সেই যে জীবনের অন্য দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পেলেন মানুষটা, তারপর থেকে তার বিরাম ছিলো না একটুকুও। তিনি কেবলই ছুটে বেড়িয়েছেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ প্রবাদের উপর আমরা লিখে গেছি ভাবসম্প্রসারণ। কিন্তু, স্যার ফজলে হাসান আবেদ নিজেই এই প্রবাদের সমার্থক হয়ে উঠেছেন, প্রবাদতুল্য এক মহামানবের জন্ম দেখেছে বাংলাদেশ। যার উত্থানে উন্মেষ ঘটেছে গ্রামবাংলায়, যিনি নীরবে শুরু করেছিলেন অদ্ভুত এক অহিংস বিপ্লব।
সেই সময়টা এমনিতেই উত্তাল। চার মাস বাদে একাত্তরের মার্চ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই মাতাল হাওয়ায় ফজলে হাসান আবেদ পাকিস্থানের তরফে একটি অফার পেয়েছিলেন। শেল ওয়েল কোম্পানির লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে সারা দেশে তেল সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে তাকে। এক সপ্তাহ করেছিলেন কাজটা। কিন্তু, বাঙ্গালির উপর পাকিস্তানিদের নির্মমতা দেখে তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
একাত্তরে অন্য এক যুদ্ধ:
মানবযোদ্ধা এই মানুষটা ভাবলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে তাকে কিছু করতে হবে। তিনি ইসলামাবাদ, কাবুল হয়ে চলে গেলেন লন্ডনে। মুক্তিবাহিনীতেও যোগ দিতেই পারতেন কিন্তু ওই যে তার ভেতরের একটা ইন্সটিংক্ট সবসময়ই চিরজাগরুক, তার দ্বারা তিনি উপলব্ধি করলেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার বদলে তিনি লন্ডন থেকে এই সংগ্রামে বেশি সাহায্য করতে পারবেন।
লন্ডনে তিনি দুইটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন- ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেল্প বাংলাদেশ’। দুটো সংগঠনের উদ্দেশ্য দুইরকম। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজটি শুরু করলেন। আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের কাজে নেমে পড়লেন। সুশিক্ষিত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষটি টের পেয়েছিলেন, স্বাধীনতার পক্ষে আন্তজার্তিকভাবে আওয়াজ তৈরি করার গুরুত্বটি। এর পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তার জন্যে করলেন ‘হেল্প বাংলাদেশ’। তিনি বহির্বিশ্বে বন্ধু-সজ্জন মিলে বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তুলে ধরতে সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা, লেখালেখি করার কাজটা চালিয়ে গেলেন।
লন্ডনে তার নিজের একটা ফ্ল্যাট ছিল। তিনি মনে করেছিলেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘ হলে টাকার দরকার হবে। দেশকে সাহায্য করতে হবে। তিনি বিক্রি করে দিলেন নিজের ফ্ল্যাটটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো ন’মাসে। অর্থগুলোর অনেকটুকুই তখনো ছিল তার কাছে। তিনি দেখছেন হাজার হাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ, শরনার্থীরা ফিরছে ঘরে। দেশটা ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে। তিনি সেই ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা এবার কাজে লাগাতে চাইলেন এই মানুষদের জীবনকে গোছাবার কাজে।
দ্বীপ জ্বেলে যান..
বাহাত্তরের জানুয়ারিতে জন্মভূমিতে ফিরে আসলেন ফজলে হাসান আবেদ। গেলেন সিলেটের শাল্লায়৷ ধ্বংসস্তুপের উপর ঝুলে থাকা মানুষের ভাগ্য, সেই করুণ নিয়তি, মানুষের অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে তিনি দেখলেন কাছ থেকে। জন্মভূমির মাটিতে নতুন দিনের লড়াইটা শুরু করলেন শাল্লা থেকেই। সব হারানো মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে শুরু করলেন ‘Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee’ সংক্ষেপে যা ‘BRAC’। পরে ১৯৭৩ সালে যা হয়, Bangladesh Rural Advancement Committee (BRAC)। এভাবেই জন্ম নিলো ব্র্যাক, দিনে দিনে যে সংগঠন পৃথিবীর বৃহত্তম বেসরকারি এনজিও হয়ে আলোর জোগান দিয়েছে। পৃথিবীকে দেখিয়েছে নতুন পথ।
সেই দিনগুলোতে ফিরলে আপনাকে কল্পনা করে নিতে হবে, কিভাবে কাজটা করতেন ফজলে হাসান আবেদ। বিধ্বস্ত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পুনর্বাসন কর্মসূচি দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু, তিনি জানেন তলাবিহীন ঝুড়ি খেতাব পাওয়া দেশকে বদলাতে হলে একদম তলা থেকেই কাজ করতে হবে। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, শিক্ষা প্রদানের উপর জোর দিয়েছিলেন তিনি। হারিকেনের আলোয় দোচালা ঘরে বসে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যেতেন তিনি। নারী, শিশুকন্যাদের পড়াচ্ছেন গাছতলায় দাঁড়িয়ে, খোলা আকাশের নিচে।
রাইজ অফ ব্র্যাক: দ্য প্যাথব্রেকিং এনজিও!
তিনি দীর্ঘমেয়াদে ভাবতেন সব কিছু৷ একটা উক্তি আছে এরকম, ‘কাউকে যদি একটা মাছ দাও, সে একদিন খেয়ে বাঁচবে; কিন্তু কাউকে যদি মাছ ধরা শিখিয়ে দাও সে নিজেই বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে নিতে পারবে।’ ঠিক তা-ই। ত্রাণ দিয়ে সাহায্য করে প্রারম্ভিক কাজটা শুরু করেছিলেন, তারপর তিনি ভাবলেন এই মানুষগুলোকে কিভাবে স্বাবলম্বী করা যায়। সেই ভাবনার ফসল আজকের ব্র্যাক।
ব্র্যাক বাংলাদেশের জন্য কি দারুণ বিপ্লব ঘটিয়েছে তা অনুভব করতে পারবেন পেছনে ফিরলেই। যখন দেখবেন ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটলো, বাংলাদেশে এক অন্ধকার সময় নেমে আসলো। মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে এসময়। এতো রক্তঝরা যে স্বাধীনতা, সে স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ যারা করলো তারাও এই ভূমিতে প্রতাপ দেখাতে শুরু করলো। এমনই এক সময়ে ব্র্যাক নীরবে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করতে শুরু করলো। মেয়েরা শিখবে, পড়বে, মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে – এরকম ভাবনার কথা যেসময় কেউ ভাবেনি, তখন ব্র্যাক এই কাজগুলোই করতে থাকলো গ্রামীন পল্লীতে৷
কারণ, স্যার ফজলে হাসান আবেদ শিকড় শক্ত করতে চেয়েছিলেন। আজকের দিনে শহরে নারী স্কুটার চালিয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্য অস্বাভাবিক ঠেকে না আর কারো চোখে। একসময় নারী সাইকেল চালাচ্ছে সেটাও কেউ ভাবতে পারতো না। এই দৃশ্য বাংলাদেশে আমরা দেখেছি, ফজলে হাসান আবেদের ভিশনারি চিন্তার ফল হিসেবে। সমাজের মনস্তত্ত্বকে একদিনে তিনি পাল্টে ফেলেন নি, ধীরে ধীরে তিনি এগিয়েছেন। এগিয়েছে ব্র্যাক৷ এগিয়েছে বাংলাদেশও।
কী না করেছে ব্র্যাক!
২০০০ সালের দিকে অ্যাপল প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সাথে সাক্ষাৎ হলো ফজলে হাসান আবেদের। স্টিভ জবস বললেন, আবেদ এই মডেলটা এতো চমৎকার, তুমি কেন আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছো না? স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেশের বাইরেও কাজ করতে শুরু করলেন তারপর থেকে। পৃথিবীর ১১টি দেশে ব্র্যাক এখন কাজ করে। এখন ১ লাখ মানুষের পরিবার ব্র্যাক, সেই ব্র্যাকের ৭০ ভাগ কর্মরতই নারী!
আমরা দেখেছি সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় ব্র্যাকের নৌকা স্কুল। কত প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্র্যাক পৌঁছে গেছে তাদের কাজ নিয়ে তা অবিশ্বাস্য। প্রায় ১ কোটি সন্তানকে ব্যাক প্রাথমিক শিক্ষা অফার করেছে। যার প্রায় ৭০ শতাংশ কন্যা শিশু! এক সময় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু সাধারণ ঘটনা ছিল। আশির দশকে ঘুরে ঘুরে ব্র্যাক খাবার স্যালাইন বানানো শিখিয়েছে। পয়োনিষ্কাশন নিয়ে কাজ করেছে। টিকাদান নিয়ে কাজ করেছে। নারীদের স্বাবলম্বী করতে তাদের বানানো পণ্য বাজারজাত করতে আড়ং শুরু করেছে। ব্র্যাক প্রবাসে অভিবাসন প্রকল্পে কাজ করছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করছে।
তবুও আবেদ ভাই রেখেছেন আড়াল..
সব মিলিয়ে ব্র্যাক পৃথিবীখ্যাত হয়েছে। বিশ্ববাসী দেখেছে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ খেতাব পাওয়া দেশের সংগঠন ব্র্যাক নিজের দেশ তো বটেই, সীমান্ত ছাড়িয়ে বিশ্বের কাছেও নিজেদের হাত বাড়িয়েছে। যার পেছনে ছিলেন এক কর্মপাগল মানুষ, স্যার ফজলে হাসান আবেদ। কিন্তু, তিনি কখনো ব্র্যাক ছাপিয়ে নিজেকে হাইলাইট করতে চান নি কখনো। আমাদের দেশে যা হয়, প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিসর্বস্ব হয়ে যায়। মানুষ নিজেকে অবিসংবাদিত রুপে হাজির করতে চায়। চারদিকে শুধু নিজের নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি শুনতে হয়। কিন্তু, এই মানুষটা নিজেকে নয় ব্র্যাককেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
যাকে ভুলবে না বাংলাদেশ…
ব্র্যাককে সঠিক পথে রাখলে ব্র্যাকের লক্ষ্য উদ্দেশ্যও কখনো থেমে থাকবে না- এমনই চেয়েছেন তিনি আজন্ম। ব্র্যাকের অন্যদের মতো তিনিও বেতনভুক্তই ছিলেন। বলতেন, “আমি ব্র্যাক থেকে বেতন নিই। কিন্তু আমার নিজের কিছু নেই। আমার নিজের বাড়ি নেই, ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকি। যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করি, তখনই নিজের জন্য কিছু করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ নিজের সম্পদ গোছানোর ব্যবসা করতে গেলে গরিবদের সাহায্য করতে পারব না।”
এই নেতাকে ব্র্যাক ভুলবে কী করে!
তিনি ধীরে ধীরে কিভাবে ব্র্যাককে তৈরি করে গেছেন তা বোঝা যায়, নেতৃত্ব তৈরির রুপরেখা দেখেও। আজকের ব্র্যাকের দিকে তাকান, কি অবিশ্বাস্য মেধাবী মানুষদের কলতান এই সংগঠনজুড়ে। মানবপ্রেম আসলে কি, তা বুঝবে যদি একদিন ব্র্যাকের বৃহত্তর কর্মযজ্ঞের স্বাক্ষী হয় কেউ। সম্ভব হয়েছে কারণ, এ সংগঠনের নেতা শুধু একা নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রাখেন নি।
৬৫ বছর বয়সে তিনি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের পদ ছেড়ে দিয়েছেন, সেই ২০০১ সালের দিকে। এরপর তিনি ব্র্যাককে গাইড করেছেন চেয়ারপারসন হয়ে। এব ছর সেই পদ থেকেও সরে দাঁড়িয়ে নতুন নেতৃত্বের কাছে ব্র্যাককে তুলে দিয়ে অবসর নিয়েছেন। আজকের দিনে এরকমটা আপনি খুব সচারাচর ঘটতে দেখবেন না। একজন মানুষ এরকম পূর্ণতা নিয়ে নিজের জীবনকে সাজাতে পেরেছেন ওই যে মানবপ্রেম, ভিশন আর ইনস্টিংক্ট – যা তাকে কখনো বিচ্যুত করে নি আলোর পথযাত্রা থেকে।
জীবনের শেষ দিকে এসে নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাই তিনি কি সরল অভিব্যক্তি দিতে পারেন এই বলে, ‘আমি আনন্দিত এই ভেবে যে আমার জীবন বৃথা যায় নি।” জীবনের লক্ষ্য যদি কেউ খুঁজে পেতে চায় শুধু এই একটি বাক্যও তার জন্যে পাথেয় হতে পারে।