এম.এইচ মুরাদ:
বেলা বিস্কুটবেলা বিস্কুট চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার। সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের সঙ্গে কিংবা বিকেলের আড্ডায় বেলা বিস্কুটের বিকল্প নেই চট্টগ্রামবাসীর কাছে। বেলা বিস্কুট চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট, যা এখন সারা বাংলাদেশ জুড়ে জনপ্রিয়।
কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলের (১৯০৩-১৯৮৩) কিংবা ইতিহাসবিদ আবদুল করিম (১৯২৮-২০০৭) এর স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তার কথা।
বিবেকী লেখক অধ্যাপক আবুল ফজল তাঁর আত্মজীবনী রেখাচিত্র গ্রন্থে লিখেছেন, চন্দনপুরার বেলায়েত আলী বিস্কুটওয়ালা’র নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়েছে। রেখা চিত্রে শৈশব কৈশোরকালের একটি লাইন এ রকম ‘ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাতের বদলে খাচ্ছি গরম-গরম চা বেলা কি কুকিজ নামক বিস্কুট দিয়ে। কুকিজ ইংরেজি নাম বেলা কিন্তু খাস চাটগেঁয়ে।’
চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুটের খ্যাতি এখনতো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বেলা বিস্কুট রপ্তানি করা হচ্ছে।
”গণি বেকারি” চট্টগ্রামের চন্দনপুরা কলেজ রোডে ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুটের দোকান। গবেষকদের ধারণা, ২০০ বছর আগে উপমহাদেশে এই বেকারিতে প্রথম তৈরি হয়েছিল বেলা বিস্কুট। বেলা বিস্কুট তৈরির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গণি বেকারির নাম।
ব্রিটিশ আমলেও তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার মানুষের খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় ছিল বেলা বিস্কুট। পান্তাভাতের পরিবর্তে ধোঁয়া ওঠা চায়ে বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে সকাল–বিকেলের নাশতা সেরে নিতেন তখনকার পৌরসভার মানুষেরা। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগঞ্জে।
ঠিক কখন গণি বেকারিতে বেলা বিস্কুট তৈরি হয় তার সঠিক তথ্য নেই। তবে মোগল আমলের শেষদিকে ও ইংরেজ আমলের শুরুতে ভারতের বর্ধমান থেকে আগত ব্যক্তিরা এই বেকারিশিল্পের সূচনা করেন চট্টগ্রামে। কারো মতে অব্দুল গণি সওদাগর পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম এই বিস্কুটের প্রচলন ঘটায়।
তবে, আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তাঁর ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে বেকারি পণ্য তৈরির সূচনা হয় এ অঞ্চলে—এমন তথ্যই মিলেছে গবেষকদের লেখায়।
গণি বেকারি নিয়ে গবেষণা করা একাডেমির সহপরিচালক আহমদ মমতাজের মতে, মোগল ও পর্তুগিজদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য। তাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারিশিল্পের যাত্রা শুরু হয় প্রায় ২৫০ বছর আগে। শুরুতে রুটি তৈরি হতো বেকারিতে। এরপর ধীরে ধীরে তৈরি হয় পাউরুটি, কেক, বেলা বিস্কুট। মোগল, পর্তুগিজ বা ইংরেজদের মতো বেকারি পণ্যেও অভ্যস্ত হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ।
বেকারি পণ্য তৈরির সময় তখনকার উদ্যোক্তারা বেলা বিস্কুট নামে বিশেষায়িত বিস্কুট তৈরি করেন। এ হিসেবে বেলা বিস্কুট তৈরির ইতিহাস ২০০ বছরের কম হবে না।
চট্টগ্রামের চন্দনপুরায় কলেজ রোডে গণি বেকারিতে গিয়ে পাওয়া গেল লাল খাঁ সুবেদারের বংশধরদের। তাঁর নাম আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম। ওয়াক্ফ দলিল অনুযায়ী, বর্তমানে এই বেকারির কর্ণধার তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষ আবদুল গণির নাম অনুসারে এই বেকারির নামকরণ হয়। গণি বেকারি মোড় হিসেবে পরিচিত এলাকাটি।
আবদুল গণির পূর্বপুরুষদের এই বেকারি পণ্য তৈরির ব্যবসা থাকলেও তখন সেভাবে নাম ছিল না। পূর্বপুরুষের হাত ধরে ১৮৭৮ সালে বেকারিশিল্পে যুক্ত হন আবদুল গণি সওদাগর। ১০৫ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালে মারা যান তিনি। তার আগে ১৯৪৫ সালের ৮ অক্টোবর ওয়াক্ফ করে যান তিনি।
সে অনুযায়ী এই বেকারির হাল ধরেন আবদুল গণির ভাইয়ের ছেলে দানু মিঞা সওদাগর। তিনি মারা যাওয়ার পর ১৯৮৭ সালে তাঁর ছেলে জামাল উদ্দিন হাল ধরেন। জামাল উদ্দিন মারা যাওয়ার পর হাল ধরেন তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম।
তিনি জানান, ‘একতলা এই বেকারি ভবনটি তৈরি হয় ১৯১০ সালে। এরপর থেকে সংস্কার করা হলেও তিন স্তর ছাদের মূল অবকাঠামো টিকিয়ে রাখা হয়েছে।’
গণি বেকারির হাত ধরে বেলা বিস্কুটের প্রচলন শুরু হলেও ধীরে ধীরে সব বেকারিতে তৈরি হয় এই বিস্কুট। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেকারিশিল্পের প্রসার ঘটে চট্টগ্রামে। গণি বেকারি থেকে ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্য বেকারির পণ্য তৈরি হতো।
ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ১৭টি বেকারিতে তৈরি হতো বেলা বিস্কুট। এখনকার ক্রেতারাও বংশপরম্পরায় বেলা বিস্কুটের গ্রাহক। যাঁরা প্রবাসী তাঁরা দেশ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন বেলা বিস্কুট।
দীর্ঘসময় ধরে বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। জানা যায়, বেলা বিস্কুটের বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি মাটির তন্দুরে বানানো হতো। শুধুমাত্র তন্দুরে বানালেই নাকি বিস্কুটের আসল স্বাদ ও গুণগত মান ঠিক থাকে।