স্টাফ রিপোর্টারঃ
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হিসাব ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক মানের চায়।
সংস্থাটির মতে, বর্তমান হিসাব ব্যবস্থাপনায় অনেক দুর্বলতা রয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র আর্থিক হিসাবে ফুটে উঠছে না।
অনেক কিছু আড়ালে থেকে যাচ্ছে। ফলে হঠাৎ কোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এতে পুরো ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
আইএমএফ বলেছে, ব্যাংকগুলোর হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হলে তাদের আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে। কোনো কিছু আড়াল করা যাবে না। সমস্যা বুঝে ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে। আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।
বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে। এ ঋণের ব্যাপারে আলোচনা করতে ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত আইএমএফ-এর মিশন বাংলাদেশ সফর করেছে। ওই সময়ে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। ওই আলোচনার সূত্র ধরে আইএমএফ ব্যাংকগুলোর হিসাব ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে একটি কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে। এর আলোকে ব্যাংকগুলোকে হিসাব ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে হবে। এজন্য আইএমএফ দুই বছর সময় দিয়েছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ-এর শর্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আইএমএফকে জানানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানের। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হিসাব পদ্ধতির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে কোন কোন বিষয় বার্ষিক হিসাবে রাখতে হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করেই ওই সার্কুলার জারি করা হয়েছে। কোনো ব্যাংক ওই সার্কুলারের ব্যত্যয় ঘটালে এবং তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিগোচর হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আইএমএফ বলেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর হিসাব ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ফাঁকি রয়েছে। কিছু বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে হিসাবে গরমিল রয়েছে। এক্ষেত্রে অডিট ফার্মগুলোও ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। ফলে কোনো ব্যাংকের দুর্বলতা প্রকাশ পেলে দেখা যায় তাদের হিসাব ব্যবস্থাপনায় গরমিলে ভরা।
আইএমএফ মনে করে, হিসাব পদ্ধতিতে ফাঁকি দেওয়া বা ভুল তথ্য দেওয়া বড় ধরনের আর্থিক অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকা উচিত। একই সঙ্গে ওই আইনের প্রয়োগ করা জরুরি।
সূত্র জানায়, এর আগে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের আর্থিক দুর্বলতার শিকার হয়ে আমানতকারী অর্থ পরিশোধ করতে পারছিল না। ওইসব প্রতিষ্ঠানে তদন্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের হিসাব পদ্ধতিতে বড় ধরনের জালিয়াতি পেয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সঠিক তথ্য না দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। ওই ঘটনায় কতিপয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ও চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটালেও অভিযুক্ত অডিট ফার্মগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, যেসব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্মের হিসাব অডিট ব্যবস্থাপনা ভালো, তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকা থেকে ব্যাংকগুলোকে অডিটর নিয়োগ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এখন থেকে হিসাব পদ্ধতিতে জালিয়াতির সুযোগ বন্ধ হবে। তারপরও কেউ জালিয়াতির আশ্রয় নিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অতীতে যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়েছে প্রত্যেকের হিসাব ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের জালিয়াতি ছিল। তারা ভুল তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ভালো দেখিয়েছে। কিন্তু ভেতরে দুর্বলতাগুলো ক্যানসারে রূপ নিয়েছে। ধীরে ধীরে তা প্রসারিত হয়েছে। একটি পর্যায়ে প্রকাশিত হয়েছে। তখন আর কারও পক্ষে তেমন কিছু করার ছিল না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। এগুলো শনাক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। একই সঙ্গে যারা তথ্যের গরমিল করার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
এছাড়া আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খেলাপি ঋণ, জিডিপির হিসাব, মূল্যস্ফীতি নিরূপণের হিসাব পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এসব খাতেও হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানের করতে বলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব আন্তর্জাতিক মানে করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই নিট হিসাব করছে। তবে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে না। আইএমএফ নিট হিসাব প্রকাশ করতে বলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটু সময় নিয়ে প্রকাশ করতে সম্মত হয়েছে।
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করার জন্যও সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। কেননা করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে উদ্যোক্তাদের কিছুটা ছাড় দিতে এ খাতে নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে।
জিডিপির হিসাব পদ্ধতি আধুনিকায়নের বিষয়ে আইএমএফ-এর সহযোগিতায় একটি কাঠামো তৈরির কাজ চলছে। এটি শেষ হলে এর হিসাব পদ্ধতি আধুনিকায়ন করা সম্ভব হবে বলে জানানো হয়েছে আইএমএফকে।