এম.এইচ মুরাদঃ
চলমান পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে চাইছে অরাজনৈতিক দাবি করা আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গত সোমবার রাতে হঠাৎ করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। মন্ত্রীর সঙ্গে তাদের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। এ সময় তারা দাবি করেন, সাম্প্রতিক সময়ের জ্বালাও-পোড়াওয়ের সঙ্গে হেফাজত নয় বরং তৃতীয় কোনো পক্ষ জড়িত। হেফাজত নেতারা রমজানের মধ্যে আলেম-ওলামাদের গণগ্রেফতার বন্ধ করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। পাশাপাশি দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়ার প্রস্তাবও দেন তারা।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেফাজত নেতাদের জানান, কোনো গণগ্রেফতার চলছে না। যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। এদিকে এরই মধ্যে একটি ভিডিও বার্তাও দিয়েছেন সংগঠনটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। বার্তায় তিনি দাবি করেন, হেফাজত জ্বালাও-পোড়াওয়ে বিশ্বাস করে না। কুচক্রী মহল নানা প্রকার গুজব রটাচ্ছে। এসব গুজবে কান না দেওয়ার জন্য তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে হয়রানি বন্ধ করে অবিলম্বে গ্রেফতার নেতাদের মুক্তি দেওয়ারও অনুরোধ জানান তিনি।
হঠাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হেফাজত নেতারা :
গত সোমবার রাত ১০টা। হঠাৎ করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ধানমন্ডির বাসায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম। তার সঙ্গে ছিলেন সংগঠনটির নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক ও খেলাফত আন্দোলনের আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জীসহ বেশ কয়েকজন। ঘণ্টাব্যাপী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে রাত ১১টার দিকে বেরিয়ে আসেন হেফাজত নেতারা। কিন্তু সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মাওলানা নুরুল ইসলাম ও মাহফুজুল হক। তবে বৈঠকের বিষয়ে আতাউল্লাহ হাফেজ্জী বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্যই মহাসচিব মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। এ বিষয়ে এখন আর কিছুই বলতে চাচ্ছি না।’
জ্বালাও-পোড়াও করেছে তৃতীয় পক্ষ :
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নেতাদের গ্রেফতার বন্ধ করতে এবং কওমি মাদ্রাসা খুলে দিতে অনুরোধ করেন। এ সময় মন্ত্রীর পক্ষ থেকে হেফাজতের মোদিবিরোধী কর্মসূচি ও হরতালে সারা দেশে যে জ্বালাও-পোড়াও এবং হামলার ঘটনা ঘটেছে, সে প্রসঙ্গটি আলোচনায় আনা হয়। তখন উপস্থিত হেফাজত নেতারা বলেন, সারা দেশের জ্বালা-পোড়াওয়ের সঙ্গে তাদের সংগঠনের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তৃতীয় কোনো পক্ষ এটা করেছে। সরকার সঠিকভাবে তদন্ত করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এতে করে দুই পক্ষের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে তারও অবসান ঘটবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের এক নেতা বলেন, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল। বৈঠকে সে বিষয়গুলো আমরা পরিষ্কার করেছি। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আপনারা এই করেছেন, ওই করেছেন। আমরা তখন বলেছি, এগুলো হেফাজতের কাজ নয়, তৃতীয় পক্ষ করেছে। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। এছাড়া আমরা পবিত্র রমজান মাসে আলেম-ওলামাদের গণহারে গ্রেফতার বন্ধ করা এবং কওমি মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় তুলে ধরেছি।
এদিকে বৈঠকের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না। হঠাৎ করেই হেফাজতের নেতারা বাসায় এসে হাজির হন। তারা দাবি জানান, হেফাজত নেতাদের যাতে গণগ্রেফতার না করা হয়। আমি তাদের বলেছি, কোনো গণগ্রেফতার হচ্ছে না। যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, ঠিক তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। পাশাপাশি করোনার কারণে বন্ধ কওমি মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।’
যা বললেন হেফাজতের আমির :
হেফাজত সম্পর্কে কোনো গুজবে কান না দেওয়ার জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনটির আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। একই সঙ্গে তিনি নেতা-কর্মীদের ধৈর্যধারণ করে সংঘাত ও ভাঙচুরে না জড়ানোরও আহ্বান জানান। গত সোমবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় বাবুনগরী বলেন, হেফাজত শান্তি-শৃঙ্খলা চায়। কোনো অশান্তি বা বিশৃঙ্খলায় যেতে চায় না। কোনো সংঘাতে যেতে চায় না। কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানো হেফাজতের উদ্দেশ্য নয়। কোনো পার্টি বা দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হেফাজত ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। হেফাজতের উদ্দেশ্য আল্লাহর জমিনে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর এজেন্ডা বাস্তবায়ন। তাই জনগণ এবং সরকারকে আমি বলব, আপনারা গুজবে কান দেবেন না।
তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন ২০২১। এই ১১ বছরে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না অমুক পার্টির সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক ছিল। আমি হেফাজতে ইসলামের অবস্থান পরিষ্কার করলাম। এসব কিছুর পর প্রশাসন মাহে রমজানে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী, হক্কানি ওলামায়ে কেরামদের বুজুর্গানে দ্বীন, দেশের ছাত্রজনতা, তৌহিদি জনতাকে হয়রানি করছে।
হাটহাজারী মাদ্রাসার আশপাশে কেউ ঘরে নেই। তারা এসব আন্দোলনে ছিল না। কিন্তু তারা ঘরে থাকতে পারে না। সব ঘর খালি। মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের যেসব ওলামায়ে কেরামসহ নির্দোষ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের অবিলম্বে নিঃশর্তে মুক্তিদান করুন। হেফাজতের আমির বলেন, বড় বড় আলেম মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাদী, মুফতি সাখাওয়াত হোসেন রাজি, মাওলানা মনজুরুল ইসলাম আফেন্দি, মুফতি ইলিয়াস হামিদীসহ ওলামায়ে কেরাম, তৌহিদি জনতা, ছাত্রজনতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকে সারারাত বাইরে বাইরে ঘোরে, ঘরে আসতে পারে না গ্রেফতার হয়রানির ভয়ে। সেহরির সময়, ইফতারির সময় ঘরে আসে তখন ধরে নিয়ে যায়। মদিনানগর মোহাদ্দেস মাওলানা মুফতি বশির উল্লাহকে তারাবির নামাজ পড়ার সময় ধরে নিয়ে গেছে। কেমন হয়রানি, কেমন নির্যাতন? এভাবে তো দেশ চলতে পারে না। হেফাজতের নেতাকর্মীর উদ্দেশে বাবুনগরী বলেন, আপনারা সবুর করুন, কোনো সংঘাত, ভাঙচুর জ্বালাও পোড়াও করবেন না।
বাবুনগরী বলেন, গত ২৬ মার্চ শুক্রবার কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। অথচ ২৬ মার্চ হেফাজতে ইসলামের কোনো কর্মসূচি ছিল না। আমাদের কোনো কমান্ড ছিল না। আমি নিজে হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছিলাম না। দূরে সফরে ছিলাম। এর আগে বায়তুল মোকাররমেও কিছু মুসল্লি কেরামের মাঝখানে কিছু অঘটন হয়েছে। ক্যাডাররা মুসল্লিদের মারধর করেছে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে। এরপরে হাটহাজারীর ঘটনা ঘটেছে। যার জন্য আমরা দুঃখিত।
আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব কোনো ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের কোনো কর্মসূচি ছিল না। কোনো কমান্ড ছিল না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি আসা উপলক্ষে হেফাজতে ইসলামের কোনো কর্মসূচি ছিল না। কিছু কিছু বক্তা কিছু বললেও হেফাজতের কোনো কর্মসূচি ছিল না। এই হলো হেফাজতের অবস্থান।