মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল আজিজ:
মুমিনকে আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ করে পবিত্র রমজান মাস। রমজানের রোজা আল্লাহ তায়ালার কাছে এতোটাই প্রিয় যে আল্লাহ তায়ালা নিজেই এর প্রতিদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব। (মুসলিম, হাদিস, ২৭৬০)।
আত্মিক পরিশুদ্ধির মাস রমজান আসার দুইদিন আগেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। রজব-শাবানে বরকত লাভের দোয়া করতেন। শাবানে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে দীর্ঘ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাত কামনা করতেন।
এ বিষয়ে এক হাদিসে আম্মাজান হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বর্ণনা করেন—একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এতো দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো- তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না- হে আল্লাহর রাসুল। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।
তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শবে বরাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি: ৩/৩৮২-৩৮৩; তাবারানি: ১৯৪)
এ রাতের ব্যাপারে যত্নশীল হতে বলেছেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কারণ, আল্লাহ তায়ালা এ রাতে ক্ষমার ঘোষণা করেছেন। হজরত মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অর্ধ শাবানের রাতে (শবেবরাতে) আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টিজগতের প্রতি মনোযোগ দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
(সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫; মুসনাদুল বাজ্জার, হাদিস : ২৭৫৪, আল মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৬৭৭৬; আল মুজামুল কাবির, হাদিস : ২১৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৯০; মুসন্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ৩০৪৭৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৬২০)
শাবান মাসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশি বেশি রোজা রাখার কথা একাধিক হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত। প্রতি মাসের মতো এই মাসেও তিনদিন আইয়ামে বীজের রোজা রয়েছে। একই সঙ্গে ১৫ তারিখে শবে বরাত বা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানের একটি রোজার কথা বর্ণিত হয়েছে এক হাদিসে। হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পনেরো শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং পরদিন রোজা রাখ। (ইবনে মাজা, হাদিস, ১৩৮৪)
রমজানে ফরজ রোজার পাশাপাশি নফল ইবাদত, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির আজকার, তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা লাভের চেষ্টা করা হয়। শবে বরাত বা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানে রাত জাগার মাধ্যমেও আল্লাহর কাছে রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। শবে বরাতের দুই সপ্তাহ পরেই শুরু হয় রমজান। সব মিলিয়ে মধ্য শাবানের রজনী আরও একবার মনে করিয়ে দেয় রমজান এবং রমজানের প্রস্তুতির কথা।