মুফতি সাদেকুর রহমান;
ব্যবসা-বাণিজ্য এক অনন্য বরকতময় জীবিকা। স্বয়ং নবীজি (সা.) ব্যবসা করেছেন, উম্মতকে ব্যবসা করতে উৎসাহিত করেছেন। ব্যবসায়ীদের দিয়েছেন বিস্তর দিকনির্দেশনা। তাদের সততা, সত্যতা ও বিশ্বস্ততা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ধোঁকা-প্রতারণা, ঠকবাজি, মিথ্যা ও পণ্যে ভেজাল মেশাতে নিষেধ করেছেন। তারই বালে দেওয়া পন্থায় সাহাবায়ে কেরাম ব্যবসা করেছেন এবং ব্যবসায়ী বেশে সাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনরা আমাদের ভারত উপমহাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে ইসলামের বাণী পৌঁছিয়েছেন।
সেসব আদর্শ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মানুষ ইসলামের সৌন্দর্য অবলোকন করেছে। লেনদেনের স্বচ্ছতা স্বচক্ষে দেখেছে। তাদের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছে। তাদের চরিত্রের সৌরভে সুবাসিত হয়েছে। ফলে তারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
কিন্তু আজ মুসলিম ব্যবসায়ীরা সে সব পূর্বসূরী মহামনীষীদের দেখানো পথ থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছে। ধোঁকা-প্রতারণা, মিথ্যা, মাপে কম দেওয়া ও মালে ভেজাল মেশানো যেন তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কাস্টমারকে ঠকিয়ে একটু বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারলেই যেন তারা মহাখুশি। তাদের অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা পরকালকে ভুলে গেছে। তাদের অন্তর থেকে রাব্বুল আলামিনের কাছে জবাবদিহিতার ভয় উধাও হয়ে গেছে।
এর একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত হলো, প্রতি বছরের মতো এবারও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবসায়ীরা পবিত্র রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছে। আর আমাদের দেশের অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। এগুলোর মৌলিক কারণ হলো কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা থেকে দূরে থাকা। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে কুরআন সুন্নাহয় বর্ণিত দিকনির্দেশনাগুলো আমলে না নেওয়া।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা রয়েছে। নিচে এর প্রধানতম কয়েকটি দিকনির্দেশনা উল্লেখ করা হলো—
১. খোদাভীতি ও পরকালমুখিতা সৃষ্টি:
ইসলাম সর্বপ্রথম প্রতিটি মুসলিমকে সব ক্ষেত্রে খোদাভীরুতা, আখেরাতমুখীতা, দুনিয়াবিমুখতা ও কৃতকর্মের জবাবদিহিতা অর্জনের প্রতি জোর তাকিদ করেছে।
অর্থাৎ একজন ব্যবসায়ী যদি আল্লাহর ভয়কে দিলে সদা জাগরুক রাখে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাত চিরস্থায়ী, দুনিয়া আমলের ক্ষেত্র, আখিরাত ভোগের স্থান এই চিন্তা লালন করে, দুনিয়াতে সে যা করবে প্রভুর কাছে তাকে অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে এই ভয় তার অন্তরে বদ্ধমূল থাকে তাহলে সে ব্যবসার ক্ষেত্রে অসদুপায় অবলম্বন করতে পারবে না। কাস্টমারকে ধোঁকা দিতে পারবে না। পণ্যে ভেজাল মেশাতে পারবে না। মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারবে না।
রিফাআ (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে নবীজি বিষয়টি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। নবীজি ঈদগাহে লোকদের কেনাবেচা করতে দেখে তাদের সম্বোধন করে বললেন, ‘নিশ্চয় ব্যবসায়ীরা কেয়ামতের দিন পাপিষ্ঠ হিসেবে উঠবে। তবে তাদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে এবং পূণ্যের কাজ করে ও সত্য কথা বলে, তারা নয়।’ (তিরমিজি : ১২১০)।
২.ব্যবসায় সততা অবলম্বন:
রাসুল (সা.) ব্যবসায়ীদের সততা অবলম্বনের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। সৎ উপায়ে ব্যবসার প্রতিদান ও অসৎ উপায়ে ব্যবসার ক্ষতি সম্পর্কে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবীগণ, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি : ১২০৯)।
৩. মিথ্যা ও ধোঁকার আশ্রয় না নেওয়া:
ব্যবসায় মিথ্যা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়াকে হাদিসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি খাদ্যের ভেতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন ভেতরের খাদ্যগুলো ভেজা বা নিম্নমানেরে। এ অবস্থা দেখে তিনি বলেন, হে খাবারের পণ্যের মালিক এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি সেটাকে খাবারের ওপরে রাখলে না কেন; যাতে লোকেরা দেখতে পেত? যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২।)
তিনি আরও এরশাদ করেন, ‘কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনও ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন, যে ব্যক্তি তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে।’ (তিরমিজি : ১০৬)
৪. ওজনে কম না দেওয়া:
ব্যবসার ক্ষেত্রে ওজনে কম দেওয়া মানুষের হক নষ্টের শামিল। কোরআনে এই ঘৃণ্য কাজের পরিণতি ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। তাদের অবস্থা এই যে লোকদের থেকে নেওয়ার সময় পুরো মাত্রায় নেয় এবং তাদের ওজন করে বা মেপে দেওয়ার সময় কম দেয়। এরা কি চিন্তা করে না, একটি মহাদিবসে এদের ওঠানো হবে?’ ( মুতাফফিফীন, আয়াত ১-৬।)
প্রিয় নবী (সা.) যথাযথভাবে ওজন করে জিনিস বিক্রির তাগিদ দিয়েছেন, সম্ভব হলে কিছুটা বেশি দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ওজন করো এবং কিছুটা বেশি দাও।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৩০৫)
৫.মজুতদারি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি না করা:
ইদানীং নীতি নৈতিকতা লোপ পাচ্ছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে বেশি লাভের আশায় অবৈধভাবে পণ্য মজুত করেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ক্রেতাদের সংকটে ফেলেন তারা। অথচ অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় পণ্য মজুত করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভোক্তাদের জিম্মি করে অর্থ উপার্জন সামাজিকতা ও মানবিকতা বিবর্জিত। উপরন্তু এগুলো জাহান্নামে যাওয়ার কারণও হবে।