আহমাদুল হক:
ইসলামের একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইবাদত জাকাত। এর মাধ্যমে সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যকার দূরত্ব কমে আসে। ইসলামে জাকাত আদায়ের বিষয় ও পরিমাপ সুনির্দিষ্ট। স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক এমন মুসলিম নর-নারী জাকাত প্রদান করবেন, যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে। তবে এর জন্য শর্ত হলো-১. সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে। ২. সম্পদ উৎপাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে। ৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। ৪. সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকতে হবে। ৫. ব্যক্তি ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাতে হবে। ৬. নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকতে হবে।
জাকাতের নিসাব ও হিসাব : ক. স্বর্ণ ৭.৫ তোলা=৯৫.৭৪৮ গ্রাম (প্রায়)। খ. রুপা ৫২.৫ তোলা=৬৭০.২৪ গ্রাম (প্রায়) (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৩৯৪; আল ফিকহুল ইসলামী : ২/৬৬৯)। দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব নির্ধারণে স্বর্ণ-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিনদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরিয়তের নির্দেশ। তাই মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার নিসাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। যার কাছে সাড়ে ৫২ তোলা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা বা ব্যবসায়িক পণ্য মজুদ থাকবে, তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫০ শতাংশ) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে।
যেসব সম্পদে জাকাত ফরজ : সব ধরনের সম্পদে জাকাত ফরজ হয় না। শুধু স্বর্ণ-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়। স্বর্ণ-রুপার অলংকার সবসময় বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক, সর্বাবস্থায় তার জাকাত দিতে হবে (আবু দাউদ শরিফ : ১/২৫৫; নাসায়ি, হাদিস : ২২৫৮)। অলংকার ছাড়া স্বর্ণ-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও জাকাত ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৬১) মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা নিসাব পরিমাণ এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার জাকাত আদায় করা ফরজ। ব্যাংক ব্যালান্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতোই। এসবের ওপরও জাকাত ফরজ। টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে জাকাত ফরজ (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৭)। হজের উদ্দেশে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলেমেয়ের বিয়েশাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তারও জাকাত দিতে হবে। দোকানপাটে যা কিছু বিক্রির উদ্দেশ্যে রাখা থাকে, তা বাণিজ্যিক পণ্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮) ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে, তা স্থাবর সম্পত্তি হোক, যেমন-জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি, যেমন-মুদিসামগ্রী, কাপড়চোপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, বই-পুস্তক ইত্যাদি তা বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১০৩) যদি স্বর্ণ-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এই পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়, তা হলে এ ক্ষেত্রে সব সম্পদ হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৮১)
ভূমি বা প্লটের জাকাত : এক. যদি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ভূমি বা প্লট ক্রয় করা হয়, তা হলে প্রতি বছর ভূমি বা প্লটের বাজারমূল্য বিবেচনা করে জাকাত দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ-কেউ যদি পাঁচ লাখ টাকায় পাঁচটি প্লট ক্রয় করে, তারপর এক বছরের মাথায় ওই প্লটের বাজারমূল্য সাত লাখ টাকা হয়ে যায়, তা হলে তাকে সাত লাখ টাকার জাকাত দিতে হবে। দুই. যদি নিজের বসবাসের জন্য ক্রয় করা হয়, তা হলে ওই প্লটের জাকাত দিতে হবে না। তা ছাড়া ব্যবসা বা বসবাসের উদ্দেশ্য ছাড়া এমনিতে ক্রয় করলেও ওই জমি বা প্লটের জাকাত দিতে হবে না। (আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, তৃতীয় খ-, পৃষ্ঠা ২৮৪)
দোকানের পণ্যের জাকাত : দোকানের ডেকোরেশন, আলমারি, তাক ইত্যাদি মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ নয়, বরং সেল বা বিক্রি করার জন্য যেসব পণ্য বিদ্যমান, তার মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তা হলে তার জাকাত ফরজ হবে। জাকাত হিসাব করার পদ্ধতি হলো, বছরের একটা সময় দিন-তারিখ নির্ধারণ করে দোকানে বিদ্যমান পণ্যের মূল্যের হিসাব করে দেখা গেল, পাঁচ লাখ টাকার পণ্য আছে। অতঃপর ওই বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আবার আনুমানিক পণ্যের মূল্য ধরে দেখা গেল, শুরুতে যে পরিমাণ সম্পদ ছিল, তা নিসাব পরিমাণ। আবার এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর যে পণ্য আছে, তা-ও নিসাব পরিমাণ, তা হলে সমুদয় সম্পদের আড়াই শতাংশ জাকাত দিতে হবে। (তাতারখানিয়া : ৩/১৬৯; হিন্দিয়া : ১/১৮০; দুররুল মুখতার : ৩/১৮২)