স্টাফ রিপোর্টার:
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দেশজুড়ে অস্থিরতা চলছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও পুলিশের কর্মবিরতি অস্থিরতাকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, এমনকি লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। এর বেশিরভাগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক, আবার কিছু ঘটনা সুযোগসন্ধানী অপশক্তি ঘটিয়েছে।
তবে এ সহিংসতা ঘিরে ভারতের কতিপয় গণমাধ্যম প্রচার করছে উসকানিমূলক প্রতিবেদন। আর ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক ও ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে ভয়াবহ প্রোপাগান্ডা ও গুজব।
সাম্প্রদায়িক রং মাখিয়ে বানানো এসব গুজব-প্রোপ্রাগান্ডার ঢেউ এসে পড়ছে বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সোশ্যাল প্লাটফর্মেও। ফলে অস্থিরতা আরও উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে।
স্রোতের মতো ছড়াতে থাকা এসব প্রোপাগান্ডা ধরে ধরে শনাক্তে হিমশিম খাচ্ছেন ফ্যাক্ট-চেকাররা। বেশিরভাগ প্রোপাগান্ডাই যে ভয়াবহ এবং পরিকল্পিত সে কথাও বলছেন কেউ কেউ। রিউমার স্ক্যানার, ডিসমিসল্যাবের মতো ফ্যাক্ট-চেকিং বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমও এসব প্রোপাগান্ডা-গুজব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
রিউমার স্ক্যানার গত শুক্রবার (৯ আগস্ট) রাতে জানায়, তারা ভারতীয়দের ছড়ানো ২০টিরও বেশি গুজব শনাক্ত করেছে। পরে শনিবার (১০ আগস্ট) জানা যায়, ভারতীয়দের ছড়ানো মারাত্মক পর্যায়ের গুজব শনাক্ত হয়েছে ৩০টির বেশি।
তারা জানায়, গত ৭ আগস্ট বিকেলে এক্সে মোহন গৌড়া নামে আইডি থেকে একটি ছবি পোস্ট করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ-আসাম সীমান্তে শরণার্থীদের ভিড় তৈরি হয়েছে’। অথচ যে ছবি পোস্ট করা হয়েছে, সেটি ২০১৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দুই দেশে বসবাসরত বিচ্ছিন্ন আত্মীয়দের মিলনমেলার ছবি।
৭ আগস্ট বিকেলেই এক্সে সালওয়ান মোমিকা নামে আইডি থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে ইরাকের মতো হিন্দু নারীদের বন্দি করে বিক্রি করা হচ্ছে’। অথচ ওই ভিডিওটি বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রীকে বেঁধে রাখার সময়ের।
সেদিন সন্ধ্যায় ‘দ্য জয়পুর ডায়লগস’ নামে ভেরিফায়েড এক্স আইডিতে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও হত্যা করা হচ্ছে। তারা গণহত্যার ঝুঁকিতে’। অথচ ওই ভিডিও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের বিচারের দাবিতে মৌন প্রতিবাদী নাটকের।
৭ আগস্ট সকালে ‘সুদর্শন নিউজ’ নামে ভেরিফায়েড এক্স আইডিতে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলা হয়, ‘লক্ষ্মীপুরে রাজন চন্দ্র নামে এক হিন্দুর দোকান আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’। অথচ ওই ভিডিও লক্ষ্মীপুরেরই মজুচৌধুরীর একটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের।
৬ আগস্ট ‘র্যান্ডমসেনা’ নামে ভেরিফায়েড এক্স আইডিতে একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়, ‘আরেকটি হিন্দু মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়েছে’। অথচ ওই ভিডিও সাতক্ষীরার রাজপ্রাসাদ রেস্টুরেন্টে আগুনের ঘটনার।
৬ আগস্ট দুপুরে ‘বাবা বেনারস’ নামে ভেরিফায়েড এক্স আইডিতে একটি পোস্টে দাবি করা হয়, ‘রংপুরে দুই শিশুসহ ৬ নারীকে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারা হয়েছে’। অথচ রংপুরে এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
৫ আগস্ট রাতে ‘হিন্দুত্ব নাইট’ নামে এক্স আইডিতে একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখা হয়, ‘বাংলাদেশের হিন্দু ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে’। অথচ ওই ভিডিওটি মাশরাফির বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনার। তাছাড়া, লিটন নিজে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তার বাড়িতে এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তিনি নিরাপদে ও ভালো আছেন।
৬ আগস্ট মধ্যরাতে ওই একই আইডিতে আরেকটি ভিডিও দিয়ে পোস্টে দাবি করা হয়, ‘হিন্দু বৃদ্ধকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ’ অথচ ওই ভিডিওটি ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল ইসলাম হিরণের মৃতদেহের।
এছাড়া চাঁদপুরের আলোচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানের মৃতদেহের ভিডিওকে প্রচার করা হয়েছে হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারার ভিডিও বলে। ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধ বিহারে সহিংসতার ভিডিওকে প্রচার করা হয়েছে সাম্প্রতিক ঘটনা হিসেবে।
এদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবও শনাক্ত করেছে কিছু গুজব। এর মধ্যে, ৫ আগস্ট রাতে একটি গুজব এক্স-এর ‘ডেইলি লেটেস্ট আপডেটস’ নামে ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়িয়েছে। সেই অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট করে বলা হয়, চট্টগ্রামের নবগ্রহ মন্দিরে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়েছে।
এক্স-এর তথ্য অনুসারে, অ্যাকাউন্টটি ভারত থেকে পরিচালিত হয়। যাচাইয়ে নেমে সাঈদ খান সাগর নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টে বলা হয়, নবগ্রহ মন্দিরে হামলার দাবিটি একটি প্রোপাগান্ডা। যোগাযোগ করা হলে পোস্টদাতা জানান, চট্টগ্রামের লালদিঘী পাড় সংলগ্ন নবগ্রহ মন্দিরে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। তাকে এক্সে প্রচারিত ভিডিওটি পাঠানো হলে, তিনি বলেন যে এটি মূলত মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুরের ঘটনায় সৃষ্ট আগুন। তিনি অক্ষত মন্দিরের ছবি পাঠিয়ে জানান, মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক স্বপন দাসও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। একই ভিডিওটি প্রচার হতে দেখা যায় ভারতের গণমাধ্যম রিপাবলিক টিভিতে। ৬ আগস্টে রিপাবলিক বাংলার অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম করা হয়, “চট্টগ্রামে লালদিঘি পাড় নবগ্রহ মন্দির ভাঙচুর। ” অথচ খবরটি পুরোপুরি বানোয়াট।
অন্যদিকে এএফপির বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকবিষয়ক সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশিরও কিছু গুজব-প্রোপাগান্ডা শনাক্ত করে তার ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করেছেন।
এর মধ্যে একটি হলো, ‘গত কয়েকদিন ধরে একটি কথিত মেসেজ কনভারসেশনের স্ক্রিনশট পোস্ট করে দেখানো হচ্ছে যে, কোটা আন্দোলন চলাকালে কোনো মেসেজ গ্রুপে একটি হিন্দু মেয়েকের ধর্ষণের ছবি দিয়ে গর্বভরে প্রচার করছে মৌ/লবাদী স/ন্ত্রাসীরা। তবে যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, একই রকম ছবি ২০২১ সালে ভারতে একজন নারীর ধর্ষিত হওয়ার খবরের সাথে প্রকাশিত হয়েছিল। ’
এছাড়া, নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় এক নারীকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তোলার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দাবি করা হয়, এক হিন্দু তরুণীকে অপহরণ করা হয়েছে।
তবে দেশের মূলধারার গণমাধ্যম প্রতিবেদন করে জানিয়েছে, ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক হামলা বা সহিংসতার ঘটনা ছিল না। ওই নারীকে অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন তার স্বামী। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাম্পত্য বিরোধের জেরে স্বামীর ঘর থেকে বাবার বাড়িতে চলে এসেছিলেন ওই নারী। তাকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তার স্বামীসহ কয়েকজন ব্যক্তি। তখন ওই নারীর চিৎকার শুনে গ্রামবাসী এগিয়ে আসেন। তারা মাইক্রোবাসটি ভাঙচুর করেন। এ সময় ওই নারীর স্বামীসহ তিনজনকে তারা আটক করেন। আটক ব্যক্তিদের সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হয় বলে জানায় গ্রামবাসী।
কদরুদ্দিন শিশিরও বিষয়টি তার আইডিতে শেয়ার করেছেন। এক্ষেত্রে বিদেশে থাকা এক ব্যক্তির একটি ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি থেকে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন।
সিলেটে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণেরও একটি খবর ছড়ানো হয়। রিউমার স্ক্যানারের সিনিয়র ফ্যাক্ট-চেকার সোহানুর রহমান একটি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানান, সিলেটে যে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে, তারা আওয়ামী লীগের নেতা। এই তথ্য দিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। ওই সংগঠনের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি এখন পর্যন্ত জানি, কোনো নিরীহ হিন্দু সিলেটে আক্রান্ত হননি। যারা হয়েছেন, তারা আওয়ামী লীগের নেতা।
গণমাধ্যমের নাম দিয়ে মিথ্যা প্রচারণা
এদিকে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি দেশের সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে গুজব-প্রোপাগান্ডা। সম্প্রতি প্রথম আলোর বরাত দিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যেখানে লেখা হয়, ‘প্রথম দিনেই ৬২ হাজার গ্রামে লুটপাট। ’
খোদ প্রথম আলো এই পোস্টের বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা দেয়। তারা ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় একটি পোস্ট দিয়ে জানায়, এটি মিথ্যা প্রচারণা। প্রথম আলোর নামে ছড়ানো তথ্যটি নকল এবং তাদের প্রকাশিত নয়।
গুজবের এই রমরমা কারবার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের গবেষক মিনহাজ আমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘গুজবের সীমান্ত পার হওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়। খবর যেমন বৈশ্বিক, ভুয়া খবরও বৈশ্বিক। এর আগেও ২০২১ সালে কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময়েও বাংলাদেশের ভুয়া খবর ভারতে ছড়িয়েছে। ভারত-বাংলাদেশে ভুয়া খবর দ্রুত সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার কারণ আমাদের মধ্যে ভাষা সংস্কৃতি ধর্মের সাদৃশ্য আছে। ফলে বাংলাদেশ বা ভারত যে কেউ অশান্ত হলে ভুয়া খবর দুই পক্ষকেই খুব জলদি আক্রান্ত করতে পারে। এজন্যে সবার আগে ভুয়া খবর কেন কীভাবে ছড়ায় সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা উচিত। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুক বা টিকটকে ভুয়া খবর রোধ করার যে আয়োজন বা চেষ্টা আছে, এক্স বা ইউটিউবে নেই। তার মানে কোনো কোনো সামাজিক মাধ্যমে বেশি অপতথ্য ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে, তার ইশারা পাওয়া যায়। ’
তিনি বলেন, ‘ভুয়া খবর থেকে রক্ষা পাওয়ার আরেকটি মোক্ষম উপায় আছে, মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর যথাযথ ভেরিফিকেশন প্রসেস অনুসরণ করা। তাহলে ব্যবহারকারীরা খুব জলদি সঠিক তথ্য পেতে পারে, বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ কমে যায়। গবেষণা বলে, যে কোনো সামাজিক রাজনৈতিক উত্তেজনার সময়ে যথাযথ তথ্য প্রবাহের অভাব ঘটলেই সেখানে ভুয়া খবর তৈরি হয়। এদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। ’
রিউমার স্ক্যানারের সিনিয়র ফ্যাক্ট-চেকার সোহানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের পতনের পরে যে ঘটনাগুলি ঘটেছে তা মূলত প্রতিশোধপরায়ণ সহিংসতা। ধর্মীয়ভাবে ভাগ করে বললে আওয়ামী লীগের মুসলিম নেতা-কর্মী এবং হিন্দু নেতা-কর্মী উভয়ের ওপর হামলা হয়েছে। তবে সমাজিক মাধ্যম বিশেষ করে এক্সে চেরি-পিক করে আওয়ামী লীগের হিন্দু নেতা-কর্মীদের ওপর রাজনৈতিক কারণে হওয়া হামলার ঘটনাগুলি সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে এবং এই অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ ভায়োলেন্সকে অ্যান্টি-হিন্দু ভায়োলেন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। হিন্দুদের ওপর আক্রমণের সব ঘটনাকেই সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন পুরনো ও ভিন্ন ঘটনার ছবি/ভিডিও সাম্প্রতিক হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। এমনকি বেশ কিছু উদাহরণ দেখেছি, যেখানে মুসলিম ধর্মের ভুক্তভোগীকে হিন্দু হিসেবে তুলে ধরে প্রচার করা হয়েছে। এভাবে পরিস্থিতির একটা ভুল চিত্রায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনাগুলির অধিকাংশ রাজনৈতিক। অর্থাৎ এসব হামলা হিন্দু হওয়ার কারণে নয়, হয়েছে আওয়ামী লীগের লোক হওয়ার কারণে। তবে এর পাশাপাশি আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলোর মধ্যে সাম্প্রদায়িক কারণও রয়েছে। আমাদের বর্তমান সংকটটা রাজনৈতিক। কিন্তু এক্সে প্রচার দেখলে মনে হবে সমস্যাটা যেন ধর্মীয়। যেখানে অধিকাংশ ঘটনাই রাজনৈতিক সেখানে সব ঘটনাই সাম্প্রদায়িক বলে প্রচার করা হচ্ছে।
ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার ধরা পড়ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে
ভারতীয় সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই প্রোপাগান্ডা বা গুজবের বিষয়টি ধরা পড়ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের চোখেও। এরই মধ্যে কাতারের আল জাজিরা একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন করেছে, এতে বলা হয়েছে, ভারতীয় গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মে বিভ্রান্তিকর নিবন্ধ ও ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে।
টাইমস গ্রুপের মালিকানাধীন মিরর নাও এর ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিওতে চারটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার খবর দৃশ্যায়ন করা হয়েছে। যেখানে ঘটনাটি সনাতনীদের ওপর হামলা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ ওই চার বাড়ির দুটি মুসলিম মালিকানাধীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভিডিওতে জনতার হাতে ২৪টি জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার কথা বলা হয়েছে, যা স্পষ্টতই বিভ্রান্তিকর। আল জাজিরা এ বিষয়গুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করে বলেছে, এক্ষেত্রে ভারতীয় গণমাধ্যমের মিথ্যাচার প্রমাণিত হয়েছে। এ পর্যন্ত দুই হিন্দু মারা গেছেন। তাদের কাউকেই হিন্দু বলে প্রাণ দিতে হয়নি। ওই দুই হিন্দুর মধ্যে একজন ছিলেন পুলিশ এবং অন্যজন শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের লোক। দুজনই মূলত ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সহিংসতায় তিন শতাধিক আন্দোলনকারী প্রাণ হারিয়েছেন।
বিজেপিঘনিষ্ঠ ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই সেদেশের এক ছাত্র নেতাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, এ দেশে অভ্যুত্থান ইসলামপন্থিরা ঘটিয়েছে। অথচ এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। আর শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের মূলধারা সব সংবাদমাধ্যম বিষয়টিকে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ বা ‘ছাত্র-জনতার বিজয়’ বলেই উল্লেখ করে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি নিবন্ধেও দাবি করা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। যা মিথ্যা বলেই প্রতীয়মান হয় ঢাকার মূলধারার গণমাধ্যমের খবরে।
বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতীয় গণমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রঙ মাখিয়ে উসকানিমূলক প্রতিবেদনকে ‘নিয়ম পরিপন্থী’ বলছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশও।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ৬ আগস্ট রাতে এক পোস্টে বলা হয়, ‘কিছু স্থানীয় টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যেভাবে রিপোর্টিং হচ্ছে, তা খুবই দৃষ্টিকটুভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক এবং ভারতের প্রেস কাউন্সিলের নিয়মাবলীর পরিপন্থী। ’
এতে আরও বলা হয়, ‘দর্শকদের অনুরোধ, এ ধরনের কভারেজ দেখার সময় নিজস্ব বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করুন এবং মাথায় রাখুন যে চ্যানেলের দেখানো ফুটেজের সত্যতা কিন্তু কোনো নিরপেক্ষ তৃতীয় সংস্থা দিয়ে যাচাই করা নয়। একতরফা বিদ্বেষমূলক এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারের ফাঁদে পা দেবেন না। শান্ত থাকুন, শান্তি বজায় রাখুন।