জ্যোতির্ময় ধরঃ
ICRC এর এক বন্ধুর অনুরধে , গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম শহর থেকে খানিক দূরে দিয়াং এলাকায় মা মারিয়ার আশ্রমে । উদ্দেশ্য ফাদার লরেন্স দিওস এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ । আশ্রমের মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই , দিয়াং এর ইতিহাসের উপর করা সমৃদ্ধ মুর্যাাল গুলো আচমকাই মনে কৌতূহলের জন্ম দেয় । মিষ্টভাষী ও সদালাপী ফাদার লরেন্স এর অভূতপূর্ব আতিথেয়তায় , পড়ন্ত বিকেলে নিস্তব্দ পরিবেশে শুনছিলাম উনার এই মুলূকে বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প । এই অঞ্চলের দরিদ্র জেলেদের জন্য ঈশ্বরের সেবক ফ্লাভিয়ান লেপ্লান্ত সেই সুদূর কানাডা থেকে এই অঞ্ছলে এসে আশ্রমের দায়িত্ব গ্রহন করার পর , নানামুখী সেবা কাজের মাধ্যমে দরিদ্র জেলে সম্প্রদায়ের আর্থ ও সামাজিক ব্যাবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটান এবং তিলে তিলে গড়ে তোলেন তাঁর স্বপ্নের এই আশ্রম । বর্তমানে ফাদার লরেন্স দিওস , গত কুড়ি বছর ধরে প্রার্থনার সময় ঘন্টা বাজিয়ে , মা মারিয়ার আশীর্বাদ চেয়ে চলেছেন সকল সৃষ্টির মঙ্গল কামনায় ।
ফাদার লরেন্স এর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে , সাথে ফাদারের সহযোগী বিবেক গাংগুলীর সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম দিয়াং এলাকার ছোট ছোট টিলাগুলি । চারেদিকে কাজুবাদাম আর আকাশমণি গাছের ফাঁক দিয়ে ফিকে হয়ে আসা শেষ বিকেলের রোদ ,আর টিলা গুলো থেকে দৃশ্যমান কর্ণফুলীর মোহনায় ডুবন্ত দিকচক্রবাল কে পাশে ফেলে প্রবেশ করলাম মরিয়ম ধর্ম পল্লীতে । প্রায় তিনশ এর অধিক খ্রিস্টান পরিবারের বাস এই মরিয়ম ধর্ম পল্লীতে । প্রায় ঘন্টা দুয়েকের উপর হাঁটাহাঁটির কারনে পরিশ্রান্ত হয়ে , ধর্ম পল্লীর এক কুটির এ প্রবেশ করলাম পিপাসা মেটানোর উদ্দেশ্যে । সত্তর ঊর্ধ্ব এক ভদ্র মহিলা গ্লাস হাতে বেরিয়ে এলেন ।
তুমি কি জ্যোতির্ময় ? এতদিন পর ………………
এসো ভেতরে এসো …………
এই কণ্ঠস্বর আমার বহুদিনের চেনা । কত বিকেল , তাঁর বাসায় যখন আমরা (পার্থ প্রতিম শর্মা , রুপম তালুকদার , প্রয়াত সৈকত দত্তগুপ্ত , ঘোড়া শিমুল প্রমুখ।রেডিয়েন্ট ওয়ে নিয়ে ব্যাস্ত থাকতাম আর মেতে থাকতাম দুষ্টুমিতে , তাঁর ভরাট কণ্ঠে দেয়ালে সাঁটা যীশুর পটে , বাইবেল থেকে তাঁকে কতবার যে আবৃত্তি করতে শুনেছি “যীশু কহিলেন , শিশুদিগকে আমার নিকট আসিতে দাও । বারন করিও না । কারন স্বর্গরাজ্য এইমত লোকদেরই ।“ কম সময় তো নয় , সেই কেজি ক্লাস থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ।
পিতা মাতার পর যদি শিক্ষকের স্থান হয় , তাহলে আমি যে সাক্ষাৎ মা মারিয়ার সামনেই দাঁড়িয়ে । পা ধরে নমস্কার করতেই , তিনি আমায় বুকে টেনে নিলেন । হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন । কোনায় থাকা যীশুর বিগ্রহ হাত তুলে আহবান জানিয়ে আমায় বলছিল “ এসো , দেখো , পঁয়ত্রিশ বছর আগের তোমার প্রিয় একজন মানুষকে আবার খুঁজে পাওয়ার সৌভাগ্য কটা লোকের হয় ?” এই রহস্যময় সন্ধ্যায়ও আমার মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেল “গুড মর্নিং টিচার “। উনি থাকতেন এখন বন্ধু পরাগ দত্ত রা যে পাড়ায় থাকে , প্রেস ক্লাবের ঠিক পাশের গলিটায় , যেখানে একসময় বেশ কিছু খ্রিস্টান পরিবার থাকতো ঠিক সেইখানে । মর্নিং শিফটে পড়ার সুবাধে , স্কুলে ঢুকার মুখে প্রায় প্রতিদিন উনার সাথে আমার দেখা হত এবং মামনির হাত ছেড়ে , উনার হাত ধরেই বলতাম “গুড মর্নিং টিচার “।
সমস্ত খবারখবর নেওয়ার পর স্বভাবজাত বাঙ্গালী মহিলার মত উনি চলে গেলেন রান্নাঘরে । কেউ নেই উনার এখন । একমাত্র ছেলে মারা গিয়েছেন প্রায় দশ বছর । ইস্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পর , কেটে গেছে আরো ১৭ টি বছর । আর আমি ফিরে গেলাম প্রায় আটাশ বছর আগে ।
এখন তো ওটা নির্মলা মারিয়ার গির্জা । বিসাল সাইন বোর্ড । তখন ওই সাইনবোর্ড ছিল না । আমাদের স্কুলের বেসির ভাগ কর্মচারীরা থাকতেন , মামস কেয়ারের পাশে যে খ্রিস্টান পাড়া টা রয়েছে , ওখানে । আমাদের চন্দনপুরা থেকে হেঁটেই আমরা ইস্কুলে আসতাম । পথে দেখা হতো , দারোয়ান ডেভিড দাদা , ইস্কুল কম্পাউন্ডে চকলেট বিক্রেতা কালু দাদা আর অফিসের টাইপিস্ট পুরু লেন্সের চশমা পড়া রবার্ট দাদার সাথে । উনাদের দেখলেই ছুটে গিয়ে তাদের চীৎকার করে গুডমর্নিং বলা । ঊল্লেখ্য এই রবার্ট দাদার বাসায় প্রথম দেখেছিলাম বিরাট একটা চোঙা এবং তার পাশে ঘুরছে থা্লার মত কি একটা – পরে শুনেছিলাম ওর নাম নাকি রেকর্ড প্লেয়ার । ওই পাড়াটাতে গিয়ে কাউকেই আর পাই নি এবার । ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে । আর বর্ষায় ঠিক আমাদের ইস্কুলের পাহাড় গুলো থেকে দেয়াল বেয়ে নেমে আসতো , হুলুদ বালি মেশানো প্রবল ঝরনাধারা । এখন সেই দেয়ালে তথাকথিত বাঙ্গালী মনিষীদের ছবি । বাঙ্গালীও একটা জাতি আর তাদের আবার মনিষী – হাস্যকর ।
ঠিক সকাল সাতটায় , লাল ইট বেছানো মাঠটায় উচ্ছল ছেলেমেয়েগুলোতে ভরে উঠত । রোজালিন পিনেরু আর লিনা সেন মাসির ঘন্টা শোনা মাত্রই দাঁড়িয়ে পরতাম আমরা যে যেখানে রয়েছি । চোখের সামনে ভাসছিল আমাদের টিচারদের কথা – ঝুমু টিচার , গোপা টিচার , লুসি টিচার , মনিকা টিচার , অলকা টিচার , শিপ্রা টিচার । মনে পরছিল ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের ইস্কুল প্রাঙ্গনে মিনা বাজারের কথা । আমাকে দেখলেই , যে টিচাররা আমাকে বেশি আদর করতেন , লটারিতে ইচ্ছে করে আমাকে জিতিয়ে দিয়ে , দিতেন সুন্দর সন্দর সব খেলনা । একবার মোরগ লড়াই নিয়ে এহসানের (পরে কলেজিয়েট) সাথে আমার কি ঝগড়া । আর প্যান্ট ভরে পায়খানা করে দেওয়া ছিল আমাদের প্রায় সকলেরই অভ্যাস ।
শীতের সময় ১ল জানুয়ারী ইস্কুল খোলার আগে আগে ,আমার এই টিচারের পাড়ায় , প্রত্যেক বাড়ীর সামনে টাঙ্গাণো হত তারা – বড় বড় সব তারা । শীগ্রই যীশু ঠাকুরের জন্মদিন তো , তাই । যীশু ঠাকুরের জন্মদিনে , এই টিচারের বাসায় আমরা যারা পড়তাম , সবার থাকতো নিমন্ত্রন । কিন্তু পড়া বাদ নেই । আমাদের সকালে পড়ার টেবিলে বসিয়ে , টিচার খুব সুন্দর করে সেজে ইস্কুলে , গির্জায় জেতেন , প্রার্থনা করার জন্য । ওই দিন উনার বাসায় থাকতো লাল রঙের জামা পড়া এক দাদুর পুতুল । ওই দাদুটাকে রঙ বেরঙের লাইট দিয়ে সাজানো হত আর পাড়ায় ঢোকার মুখে একটা সবুজ রঙের গাছকে নানা রকম লাল , নীল বল দিয়ে সাজানো হত। টিচার আমাদের হাত ভরে চকলেট দিতেন , কেক খেতে দিতেন । একবার শিমুল চৌধুরীকে এক পিস কেক বেশি দয়ার কারনে আমার কি কান্না । টিচারকে আমাকে কথা দিতে হয়েছিল , যিশু ঠাকুরের জন্মদিন শেষ হয়ে গেলে ওই বড় তারাটা আমায় দিতে হবে । যে কাগজ দিয়ে ঘুড়ি তৈরি হয় , সেই কাগজ দিয়ে তৈরি হত তারাটা । পরে একটু বড় হয়ে জেনেছিলাম যীশু ঠাকুরের জন্মদিনকে বলে বড়দিন আর ওই লালজামা পরা দাড়িওয়ালা দাদুটাকে বলে সান্টা ক্লউস ( পাপা নোয়েল) ।
একটা উপহার দেবো তোমায় , জ্যোতির্ময় ! নেবে ?
গলায় পরিয়ে দিলেন জপমালা রাণী মারিয়ার আশীর্বাদ ক্রুশবিদ্ধ যীশু !
আবার আসবে তো ?
আসবো , বার বার আসবো । এর পরের বার কিন্তু একা না , সাথে কাউকে নিয়ে ।
জানিনা টিচার , কথা দিতে পারলাম না , আমার ওরকম কেউ নেই । ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন “বুকে ক্রুস আঁকলেন টিচার “।
আর আমি সেই সন্ধায় ফিরে আসছিলাম আরসিওয়াই অফিসের দিকে। গাড়ির জানালা দিয়ে দৃশ্যমান মেঘদল গুলোর দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছিল , মেঘের আড়াল থেকে বোধহয় যীশু মুচকি হেসে আমায় শোনাচ্ছেন মথি লিখিত সুসমাচার এর শেষ কথাটা “আর দেখো আমিই যুগান্ত পর্যন্ত প্রতিদিন তোমাদের সঙ্গে আছি”।
আমার এই টিচারের নাম জোয়ানা সরকার । ইস্কুলের নামঃ সেন্ট মেরীস ইস্কুল । সময় -১৯৮৬-১৯৯০ । আর উনার চোখের পুরো চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছি আমি ও আমার বন্ধু ডাঃ রাজীব গুহ।