সাইদুজ্জামান আহাদ:
বদলি সরকারি চাকুরীর অংশ হলেও খাদ্য অধিদপ্তরে মাহবুব কবির মিলনদের মতো মানুষদের দরকার। মাহবুব কবির মিলন নামের মানুষটাকে আমার কাছে মনে হয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো একজন। একুশ বছরের আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা সুকান্ত চেয়েছিলেন নবজাতকের জন্যে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে যেতে। আর মাহবুব কবীর মিলন চান নতুন প্রজন্মের জন্যে এই দেশটাকে বসবাসের যোগ্য করে তুলতে। যে দেশে খাদ্যে ভেজাল বলে কোন জিনিস থাকবে না, খাবার নিয়ে কেউ দুই নাম্বারী করতে পারবে না।
গত কয়েক বছরে নিজের অবস্থান থেকে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টাটা চালিয়েছেন এতদিন ধরে, খাদ্যে ভেজাল দেয়া নানা প্রতিষ্ঠানকে করেছেন বিচারের মুখোমুখি। কিন্ত ভালো কাজ করলে এই দেশে চক্ষুশূল হতে হয় অনেকের। মিলন ভাইয়ের বেলাতেও সেটাই ঘটেছে। তাকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বদলি করা হচ্ছে, জোর করে লড়াইটাকে অসম বানিয়ে ফেলে মাহবুব কবির মিলনকে হারিয়ে দেয়ার অন্যায় একটা চেষ্টা চলছে। (যদিও বদলি সরকারি চাকুরীর একটা অংশ)।
নিরাপদ খাদ্যের আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে তিনি দারুণ সরব, নিজের প্রোফাইল থেকে নিয়মিতই আপডেট দেন সবসময়। মাসখানেক তার পোস্টগুলো ফলো করলেই বোঝা যায়, খাদ্যে ভেজাল রোধ করার ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস তিনি। খাবারে যারা ভেজাল মেশায়, তাদের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধই ঘোষণা করেছিলেন মাহবুব কবির মিলন, সেই যুদ্ধটা ক্রুসেডের চেয়ে কম কিছু ছিল না।
মানুষ এবং পশুর খাদ্যে ব্যবহৃত বিপজ্জনক রাসায়নিকের আমদানি রোধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি, অস্বাস্থ্যকর হোটেল আর রেস্তোরাঁগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেছেন, সেবার মান অনুযায়ী সেগুলোকে গ্রেডিং সিস্টেমের আওতায় আনার কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, ফরমালিন বা আরও নানা ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মনে যেসব ভুল ধারণা বাস করছিল, সেগুলোকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে ভেঙেছেন তিনি, বলেছেন, আপনারা নিশ্চিন্তে ফল খেতে পারেন, বাংলাদেশের কোন ফলেই এখন আর ফরমালিন ব্যবহার হয় না।
যাদের বিরুদ্ধে মাহবুব কবির মিলন লড়ছিলেন, তারা হচ্ছে গোলিয়াথের মতো দানব, বিশাল বড় সিন্ডিকেট। তাদের সামনে মানুষটা ডেভিডের মতোই সাহস করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। লোকবল নেই, ক্ষমতা নেই, তবুও তিনি এক প্রকার অসাধ্য সাধন করেছেন সততা আর মনের জোরে। ষড়যন্ত্র হয়েছে, তাকে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকে সরিয়ে দিতে পারলে জনগন নিরাপদে থাকুক না থাকুক, খাবারে যারা ভেজাল মিশিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়, তাদের নিরাপত্তা তো নিশ্চিত হবে! সেটাই হচ্ছে এখন।
এর আগেও এমন হয়েছে অজস্রবার। সরকারী কর্মকর্তা মুনির চৌধুরী, লাইসেন্স না থাকার কারণে জিয়া পরিবারের মালিকানাধীন লঞ্চ আটক করে আলোচনায় এসেছিলেন যিনি। তাকে একের পর এক বদলি করা হয়েছে, কখনও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্পোরেশন তো কখনও ভূমি অধিদপ্তরে, কখনও আবার দুদকে- তিনি যেখানেই গিয়েছেন, নিজের সততার প্রমাণ রেখেছেন। দুদকের পরিচালক হয়ে তিনি যখন দুর্নীতিবাজদের নাভিশ্বাস তুলে ফেলার কাজ করছেন, তখন তাকে জাদুঘর পরিচালনার কাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট বানসুরি মোহাম্মদ ইউসুফকে তো সবাই চেনেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ‘অনিয়ম’ শব্দটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন যিনি। তার কাছে অভিযোগ নিয়ে গেছে, অথচ প্রতিকার পায়নি- এরকম ঘটনা ঘটেনি। এয়ারপোর্টের যাত্রীদের কাছে আস্থার আরেক নাম হয়ে উঠেছিলেন ‘ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ’। সেই মানুষটাকে বিমানবন্দর থেকে সরানোর জন্যে হাজারো ষড়যন্ত্র হয়েছে, ফান্ড তোলা হয়েছে তাকে বদলি করার জন্যে। শেষমেশ তাকে দুদকে পাঠানো হয়েছে, সেখানেও দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের বারোটা বাজানোর কাজ বিপুল বিক্রমেই করছেন মোহাম্মদ ইউসুফ।
মানুষের জন্যে সৎভাবে কেউ কাজ করতে চাইলে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। মুনির চৌধুরী, মোহাম্মদ ইউসুফেরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ, সেই তালিকায় এখন মাহবুব কবির মিলনের নামটাও যুক্ত হবে। অপরাধীদের চোখে তিনি ঘাড়ত্যাড়া, তাকে লোভ দেখিয়ে দলে আনা যায় না। তাই তাকে ছেঁটে ফেলার মিশনে নেমেছে দুর্বৃত্তের দল। উচ্চপদস্থ লোকজনও তাদেরই দলে, আর তাই জনগনের কথা ভাবার কেউ নেই!
আমি জানিনা এই ঘটনাটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কানে কখনও যাবে কীনা। খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে নিরলস লড়ে যাওয়া মাহবুব কবির মিলন নামের এই অক্লান্ত যোদ্ধাটিকে প্রধানমন্ত্রী চেনেন কিনা, সেটাও জানা নেই। চাওয়া থাকবে, এই বদলির আদেশটা যাতে তিনি বাস্তবায়ন হতে না দেন। নইলে জনগন বনাম দুর্নীতিবাজদের এই লড়াইটাতে জনগনের হার হবে, সততা হেরে যাবে বিশাল ব্যবধানে। কে জানে, এরপরে কেউ হয়তো আর মাহবুব কবির মিলন হতেও চাইবেন না, জনগনের উপকার করতে গিয়ে নিজের বুকে গুলি খাওয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবেন অনেকেই। আর তাতে দেশের মঙ্গল এর চেয়ে অমঙ্গলই হবে বেশী।